December 17, 2025

বিজয় দিবসে কথা

 বিজয় দিবসে কথা

প্রতিবেশী বাংলাদেশের বিজয় দিবস পালন চলছে এক দোটানার মধ্যে।মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয় এসেছিল পাকিস্তানের হাত থেকে। সেই লড়াই ছিল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। আজ সেই বিজয়ের ৫৪ বছর পর সেই দেশটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের শাসকবর্গের। নানা রাজনৈতিক চড়াই-উতরাই ও ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নামের বর্তমান ভূখণ্ডের মানুষ সেই দিন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পৌঁছেছিল। তখন এই অঞ্চলটি পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত ছিল। আজ বাংলাদেশ। আজকের বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এমন পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যে এই জাতি আজ তাদের বিজয় দিবসের প্রতি শ্রদ্ধা অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছে। কোন কোন রাজনীতিক প্রকাশ্যে ইতিহাসের বিকৃতি করছে। বিজয় দিবসের একদিন আগে তারা সেই দেশে পাক বাহিনীর গণহত্যার জন্য ভারতকে দায়ী করেছে। মানে বাংলাদেশে এখন বিজয় দিবস উদ্যাপন নিয়েও দ্বিধাদ্বন্দ্ব। এই ঘটনা নিঃসন্দেহে একটি জাতির জন্য অশনিসংকেত হতে পারে।

১৯৭১ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ বহুক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ও পরিবর্তনের সাক্ষী হয়েছে। ১৯৭১-পূর্ব সময়ে প্রায় সব সামাজিক ও অর্থনৈতিক সূচকেই পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় পূর্ব পাকিস্তান পিছিয়ে ছিল। বর্তমানে জিডিপি থেকে শুরু করে মানব উন্নয়ন কার্যত সব উন্নয়ন সূচকেই পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে। এর পরও এই দেশের একাংশ বুদ্ধিজীবী পাকিস্তানকেই মডেল করে চলতে চায়। এর বড় কারণ হলো বাংলাদেশে গণতান্ত্রিকতার চাষবাস কাঙিক্ষত রকম হয়নি। পাঁচ দশকেও একটা কার্যকর ও টেকসই গণতন্ত্র গড়ে তুলতে পারেনি এই দেশ। পাকিস্তানের অভিজাত শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে স্বাধীনতার সংগ্রাম ছিল কারণ তারা গণতন্ত্র অস্বীকার করে পাকিস্তানের শাসনকেই চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। আবার পূর্ব বাঙলা বা বাঙালিদের অর্থনৈতিক বঞ্চনার মূল কারণও ছিল সেটিই।
১৯৯১ থেকে ২০০৮-এই সময়কালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন তুলনামূলকভাবে স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু চারটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশে, বিরোধী দলের কাছে ক্ষমতাও হস্তান্তর করা হয়েছে। এমনকী এই ‘গণতান্ত্রিক’ আমলেও সংসদ ও বিচার বিভাগের মতো গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের উদ্দেশ্য অনুযায়ী কার্যকর হতে পারেনি। সে কারণে এক ধরনের ‘অনুদার গণতন্ত্রই’ এখানে প্রাধান্য পেয়েছে। আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে পঞ্চদশ সংশোধনী প্রবর্তনের পর স্বৈরশাসনের উত্থান হতে দেখেছে বাংলাদেশ, যার চূড়ান্ত পরিণতিতে একচ্ছত্র শাসন প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। সমস্যার মূল উৎস নিহিত রয়েছে রাষ্ট্রপতি হোক আর নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হোক, সব ক্ষমতা একজন সর্বক্ষমতাধর নেতার হাতে কেন্দ্রীভূত থাকা এবং গণতান্ত্রিক রাজনীতির ‘গোত্রীকরণের’ মধ্যে, যা শেষ পর্যন্ত সব কিছু শাসকের দখলে এমন একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম দেয় এই দেশটিতে।
প্রশ্ন আসে, মুক্তিযুদ্ধের যে স্বপ্ন ছিল তা পূরণ না হওয়ার ব্যর্থতা, বৈষম্য অব্যাহত থাকা বা গণতন্ত্রের উল্টো যাত্রা-এসব কারণে কি ২৪-এর গণঅভ্যুত্থান অনিবার্য হয়ে পড়েছিল? নাকি অন্য কোন কারণ এখানে নিহিত আছে? এই প্রশ্নের নানা জবাব, নানা রকম গবেষণা চলছে এক বছর পরেও। বস্তুত ২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থান প্রাথমিকভাবে শুরু হয়েছিল সরকারী চাকরিতে কোটাব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনে উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত থেকে। স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে গেলেও মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তরাধিকারীদের জন্য কোটা চালু রাখাটা ছিল উদ্ভট ঘটনা। শেখ হাসিনা প্রথমে কোটা বাতিল করেছিলেন এবং পরে হাইকোর্ট কোটা পুনঃপ্রবর্তনের রায় দিলে তা নিয়ে শুনানি চলছিল। বলা যায় স্বৈরতান্ত্রিক, নিপীড়নমূলক, অন্যায্য ও দুর্নীতিগ্রস্ত শাসনই চব্বিশের অভ্যুত্থানের মূল উৎস ছিল। রাজাকার নিয়ে শেখ হাসিনার অপ্রয়োজনীয় ও অযৌক্তিক মন্তব্য গণ-অভ্যুত্থানকে উসকে দিয়েছিল, নাগরিকদের দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত হতাশা ও ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটেছিল- এই নিয়ে দ্বিমত থাকার কারণ নেই।
আবার জুলাই অভ্যুত্থান হয়েছিল গণতান্ত্রিক ব্যর্থতা এবং অন্যায্য শাসনের ফলে। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি, যারা দেশটির রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরেই উপস্থিত রয়েছে, তারা এই অভ্যুত্থানে সুযোগ নিয়েছে, এর ভেতরে ঢুকে পড়েছে এবং সম্ভবত অভ্যুত্থানের গতিমুখ নির্ধারণের ক্ষেত্রেও তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। যে কোনও স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলনের সময় এমনটা ঘটে। যেসব নিপীড়িত শক্তি সুসংগঠিত ও সুশৃঙ্খল শক্তি হিসেবে থাকে, তাদের দমিয়ে রাখা হলেও সুযোগ পেলে তারা সামনে চলে আসে। বাংলাদেশেও তাই হয়েছে। অবস্থা এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে অনেকে চব্বিশের অভ্যুত্থানকে মুক্তিযুদ্ধের বিপরীতে দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন। এই চেষ্টা কেন? মুক্তিযুদ্ধ অপ্রাসঙ্গিক করার এই চেষ্টা কি সাময়িক বা বিচ্ছিন্ন কোনো চেষ্টা? নাকি যে ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষা থেকে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, তার বিরোধী শক্তি ধারাবাহিকভাবে শক্তিশালী হয়েছে এবং পরিকল্পিতভাবেই ২৪ পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধেকে আঘাত করার কৌশল নিয়েছে?
এই কথা প্রমাণিত যে জুলাই অভ্যুত্থান হয়েছিল গণতান্ত্রিক ব্যর্থতা এবং অন্যায্য শাসনের ফলে। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরেই উপস্থিত ছিল, তারা এই অভ্যুত্থানে সুযোগ নিয়েছে, এর ভেতরে ঢুকে পড়েছে এবং অভ্যুত্থানের গতিমুখ নির্ধারণের ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে তারা জোরালো নির্বাচনি সম্ভাবনাসহ আরও কিছু শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। তারা এই সুযোগকে ব্যবহার করে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাদের যে ঐতিহাসিক সহযোগিতার ভূমিকা, তাকে নতুন ভাষ্য দিতে চাইছে। রাজনৈতিকভাবে কৌশলী নেতাদের নেতৃত্বে তারা এই পর্যায়ে তাদের মুক্তিযুদ্ধ- সম্পর্কিত অবস্থান কিছুটা সতর্কতার সঙ্গে প্রকাশ করবে। ১৯৭১ সালে তাদের ভূমিকা তুলসি ধোয়া করার ক্ষেত্রে এটা তাদের একটা রাজনীতিকে কৌশল। যা দেশটির রাজনৈতিক এক অন্য খাতে প্রবাহিত করবে।অস্থিরতা যা তৈরি হবে তা শুধু বাংলাদেশ নয়,গোটা উপমহাদেশকে আন্দোলিত করবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *