November 17, 2025

ইজরায়েলের অসুখবিসুখ!!

 ইজরায়েলের অসুখবিসুখ!!

কঠোর নিয়ন্ত্রণ যে রাষ্ট্রব্যবস্থার শেষ কথা, ভালো পরিচালনা বা নিয়ন্ত্রণ মানেই কঠোরতা-সেখানে রাষ্ট্রনায়কেরা একদিন কঠিন পরিণতির মুখোমুখি হয়ে থাকেন। ইতিহাস সেই কথাই বলে থাকে। সত্যকে দমন করতে যে শক্তি একসময় বাইরের সমালোচকদের মুখ চেপে ধরত, সেই শক্তিই এখন গ্রাস করতে শুরু করে ‘ভেতরের’ মানুষদেরও। বিশেষ করে ইজরায়েলের ভেতরে বিবেকবান বলে যারা অবশিষ্ট ছিলেন তাদের। এমন মুহূর্তগুলি এই সকল রাষ্ট্রের জীবনে কখনও দামামা বাজিয়ে আসে না। আসে নীরবে, নিভৃতে। ইজরায়েল এখন এমনই এক মুহূর্তের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। দেশটির সামরিক প্রধান প্রসিকিউটর ইয়িফাত তোমের- ইরুজালমির গ্রেপ্তার। অভিযোগ, তিনি নাকি এক ফিলিস্তিনি বন্দির নির্যাতনের ভিডিও ফাঁস করেছিলেন। বিষয়টি ইজরায়েলের জন্য শুধু আইনি কেলেঙ্কারিরই নয়। সেই ফাঁস হওয়া ভিডিও তৈরি হয়েছে এমন এক আয়না, যেখানে একটি জাতি নিজের মুখোমুখি দাঁড়াতে বাধ্য হচ্ছে। নিজের চেহারা আয়নার দেখে নিজেকে বীভৎস মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে। সামরিক প্রধান প্রসিকিউটর তোমের-ইরুজালমি কোনো বহিরাগত বা প্যালেস্তাইনি শত্রু ছিলেন না, ছিলেন না ইরানের চর। এই মহিলা ছিলেন ইজরায়েলের সবচেয়ে সুরক্ষিত কোর কেন্দ্রের অংশ। ছিলেন দেশটির সেই রকম আইন ও সামরিক কাঠামোর অংশ, যে কাঠামোকে ইজরায়েল বহুদিন ধরে জাতীয় অস্তিত্বের রক্ষক বলে মনে করছে। কিন্তু সেই কেন্দ্রের ভেতরে বসেও সেই মহিলা চরম অমানবিকতা, হিংস্রতার চাষবাস করতে করতেও একসময় বেছে নিয়েছিলেন মানবিক এক অবস্থান। বেছে নিয়েছিলেন সহানুভূতি, যা মানুষের প্রতি মানুষের থাকাটা স্বাভাবিক, যা ন্যূনতম মানবিকতার দাবি। নিষ্ঠুরতার মুখোশ উন্মোচনের সিদ্ধান্ত কোনো সুস্থ মানুষের জন্য ইরুজালমির জন্য কোনো বিদ্রোহ ছিল না। ছিল নৈতিক সাহসের প্রকাশ। আর সেই সাহসের জন্যই তাকে শাস্তি পেতে হয়েছে। তার এই পরিণতি বিশ্ব মানবতার সামনে উন্মোচন করেছে এক গভীর সত্য। দেখিয়েছে, সরকার যখন নিয়ন্ত্রণে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে, তখন সততাকেও তারা ভয় পেতে শুরু করে বিদ্রোহের মতোই। ইজরায়েল নামের শক্তিশালী, আগ্রাসী, যুদ্ধবাজ যে দেশটি একসময় বাইরের হুমকিতেই শুধু আতঙ্কিত থাকতো এবং মোকাবিলায় সশস্ত্র ও কৌশলী থাকতো, সেদেশ এখন কাঁপছে নিজের অন্তর্নিহিত সত্যের সামনে। যখন সত্যকেই শত্রু মনে করা হয়, তখন জাতির শক্তি ভেতর থেকে ফাঁপা হয়ে যেতে শুরু করে, কিংবা রাষ্ট্রের শক্তি কতটা ফাঁপা তা সহজেই বুঝে যাওয়া যায়। দশকের পর দশক ধরে ‘নিরাপত্তা’ ছিল ইজরায়েলের অস্তিত্বের মূল শব্দ। রাষ্ট্রের সূচনায় এই শব্দের মানে ছিল টিকে থাকা। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি পরিণত হয়েছে অন্য এক পবিত্র ধারণায়। ধর্মীয় পবিত্রতার নামে প্রায় সবকিছুকেই, সব ধরনের নিষ্ঠুরতাকেই বৈধতা দেওয়া যায়। রাষ্ট্রের ভেতর থেকে ক্ষমতাকে প্রশ্ন করা সেই দেশে হয়ে উঠেছে এক নিষিদ্ধ কাজ। তাদের পবিত্রতার ট্র্যাজেডি হলো এমন এক মনুষ্যনির্মিত দেওয়াল, যা শুধু সীমান্তের চারপাশ নয়, জাতির বিবেককেও চারপাশ -থেকে অবরুদ্ধ করে ফেলেছে। নিজেদের রক্ষার জন্য যে দেওয়াল তোলা হয়েছিল একদিন, একসময় সেই দেওয়ালের ভেতরেই দমবন্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে দেয়। অযাচিত ক্ষমতা একসময় ভুলে যায়, কাদের রক্ষার জন্য সে সৃষ্টি হয়েছিল। যে সহিংসতাকে একসময় ‘আত্মরক্ষা’ বলে মেনে নেওয়া হয়েছিল, তা পরিণত হয় অভ্যাসে। নৈতিক পুনর্জাগরণের শেষ আশ্রয় যেসব সত্যবাদী, তাদেরও চুপ করিয়ে দেওয়া হয়। তোমের-ইরুজালমির ঘটনা তেমনই এক ট্র্যাজেডি এমনই মনে করছেন বিশ্লেষক, বিশেষজ্ঞরা। যে দেশ ওই অঞ্চলের ‘একমাত্র গণতন্ত্রপন্থী’ বলে নিজেদের দাবি করে, ওই দেশেই সহানুভূতি নামের মানবিক গুণকে অপরাধ হিসাবে গণ্য করা হচ্ছে। নির্যাতনের তথ্য প্রকাশ করাটা হয়ে উঠেছে নির্যাতন করার চেয়ে অধিক বিপজ্জনক। ইজরায়েলের নেতারা এখনও গণতন্ত্রের কথা বলেন, বিশৃঙ্খলার মধ্যেও টিকে থাকার দাবি করেন। কিন্তু সেই কথাগুলো এখন ফাঁপা শোনায়। গণতন্ত্রের স্তম্ভগুলো- বিচারব্যবস্থা, সংবাদমাধ্যম এবং তদারক সংস্থাগুলো নীরবে ক্ষয়ে যাচ্ছে। আদালত এখন দুর্বলদের নয়, রক্ষা করছেন শক্তিধরদের। সংবাদমাধ্যম দ্বিধায় ভুগছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো, যারা এক সময় দেশের বিবেক ছিল, তাদের করে ফেলা হয়েছে কোণঠাসা।
অধিকৃত এলাকার (পশ্চিম তীর) জনগণকে নিয়ন্ত্রণের জন্য একসময় যে অস্ত্রগুলো তৈরি হয়েছিল, এখন তা ব্যবহার হচ্ছে ভেতরের দিকে। যা আগে ছিল রাজৈনতিক, এখন তা হয়ে উঠেছে মানসিক, সাংস্কৃতিক- এমনকী স্বভাবগত। যেখানে সত্য বলা বিশ্বাসঘাতকতা হয়ে যায়, তখন সেই ব্যবস্থা আর শৃঙ্খলা রক্ষা করছে না, বরং নিজস্ব বিকাশের ক্ষমতাকেই শ্বাসরোধ করে ফেলেছে। তোমের-ইরুজালমির গ্রেপ্তারের বার্তা রাষ্ট্রজনকে স্তম্ভিত করছে, কারণ এই ব্যবস্থায় নীরবতাই আনুগত্য আর সততাই বিশ্বাসঘাতকতা। সহানুভূতির জায়গা নিয়েছে ভয় আর ঐক্যের জায়গা নিয়েছে সন্দেহ। তখন তো রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো হারাবে বৈধ্যতা, মানুষ হারাবে আস্থা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *