November 14, 2025

শিক্ষার অন্ধকারে!!

 শিক্ষার অন্ধকারে!!

দেশের মানচিত্রে বিহার আজও মাথাপিছু আয়ের নিরিখে পশ্চাৎপদ রাজ্য। জাতীয় গড়ের (বার্ষিক ১,৭০,০০০ টাকা) তুলনায় ৬৫ শতাংশ কম আয়, পূর্বোত্তরের ক্ষুদ্র রাজ্যগুলির থেকেও পিছিয়ে। ত্রিপুরায় যেখানে বার্ষিক মাথাপিছু আয় ৮৫ হাজার টাকা, সেখানে বিহারে মাত্র ৬৫ হাজার।প্রশ্ন একটাই- এত দারিদ্র্যের পেছনে দায়ী কে? উত্তর সহজ: শিক্ষার অধঃপতন। সাক্ষরতার হার এখনও ৭৫ শতাংশ ছুঁতে পারেনি। উচ্চশিক্ষায় অংশগ্রহণ ১৬ শতাংশে কম। কেন্দ্রীয় সরকারের স্কুল শিক্ষা রিপোর্ট বলছে, বিহারে ১১৭ টি স্কুলে কোনও ছাত্রই নেই, অথচ ৫৪৪ জন শিক্ষক বেতন নিচ্ছেন। আবার ২৬৩৭ টি এমন স্কুল রয়েছে, যেখানে মাত্র এক জন করে শিক্ষক। সরকারী তথ্য সাক্ষী, এই সব স্কুলে ২ লক্ষ ৯১ হাজার ছাত্রছাত্রী রয়েছে। বিহারে মাঝপথে স্কুল ছেড়ে দেওয়ার হার গোটা দেশে সব থেকে বেশি। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ুয়াদের এক-চতুর্থাংশ মাঝপথে পড়াশোনা ছেড়ে দেয়। নবম-দশম শ্রেণীতেও স্কুলছুটের হার ২৫ শতাংশের মতো। এই ভয়াবহ চিত্র লজ্জা নয়, রাজনীতির বেহায়াপনা জেগে ওঠে।
নীতীশ কুমারের এনডিএ সরকার বিহারে টানা দুই দশক ধরে ক্ষমতায়। বিজেপি তার প্রধান শরিক। কিন্তু শিক্ষা নিয়ে তাদের নির্বাচনি ইস্তাহার? ৬৯পৃষ্ঠার ইস্তাহারে বরাদ্দ মাত্র তিন পৃষ্ঠা। প্রতিশ্রুতি লেখা আছে- সমস্ত গরিব পরিবারের ছেলেমেয়েদের নিখরচায় শিক্ষা, মিডি-ডে মিলে পুষ্টিকর খাবারের বন্দোবস্ত হবে। তার সঙ্গে ‘প্রাথমিক থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত নিখরচায় শিক্ষা’, ‘স্কিল ল্যাব’, ‘এডুকেশন সিটি’, ‘এআই হাব’ গড়ে তোলার বার্তা। শুনতে ভালো লাগে, কিন্তু বাস্তব ছবিতে স্কুলে বিদ্যুৎ নেই, শিক্ষক নেই, ছাত্র নেই। কেন্দ্রীয় সরকারের রিপোর্টেই উল্লেখ, ৭৮ হাজার স্কুলের মধ্যে ১৬ হাজারের বেশি এখনও আক্ষরিক অর্থেই অন্ধকারে।বিহারের এই শিক্ষাগত পতন শুধু রাজ্যের দারিদ্র্যই টিকিয়ে রাখছে না, গোটা দেশের সামাজিক বুনোটকেও দুর্বল করছে। কারণ শিক্ষাহীন সমাজ কখনও আত্মনির্ভর হয় না, হয় শুধু রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির পণ্য। তাই আজও বিহারে তরুণেরা লক্ষ লক্ষ সংখ্যায় পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে অন্য রাজ্যে গিয়ে মাথার ঘাম মাটিতে ফেলেছেন। বিহারে শিক্ষাব্যবস্থার সংকটের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতিও উঠে আসে। সম্প্রতি বঙ্গে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অভিযোগ করেছেন, তৃণমূল সরকার বাংলার উচ্চশিক্ষা ধ্বংস করেছে। তৃণমূলের দুর্নীতির ফলে হাজার হাজার শিক্ষকের চাকরি গেছে। ফলত স্কুল পড়ুয়াদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারের মুখে পড়েছে।কিন্তু বিজেপি নিজে ক্ষমতায় এলে শিক্ষা নিয়ে কী করবে, তার কোনও স্পষ্ট রূপরেখা দেয়নি। ফলে দুই রাজ্যেই শিক্ষাকে ভোটের ইস্য না করে শুধু ক্ষমতার হিসাবের অঙ্কে ফেলে রাখা হয়েছে।
নীতীশ সরকারে দাবি-লক্ষ লক্ষ শিক্ষক নিয়োগ করা হয়েছে। অথচ বাস্তবে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার আবেদনই করা যাচ্ছে না। যোগ্যতা নির্ধারণের ‘সেকেন্ডারি টিচার এলিজিবিলিটি টেস্ট’ ২০২৩ সালে থেকে বন্ধ। প্রতিবাদে রাস্তায় নামলে প্রার্থীদের খাকি উর্দির লাঠির মুখে পড়তে হচ্ছে। শিক্ষার জায়গায় যখন লাঠির রাজনীতি চলে,
তখন অনিবার্য ভাবে প্রশ্ন জাগে- সরকার কাদের জন্য।
একদা নালন্দার মতো জ্ঞান চর্চার কেন্দ্র এই মাটিতেই দাঁড়িয়েছিল,সেই বিহারের মাত্র ২২.৬৭ শতাংশ মানুষ পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন।গুপ্ত রাজারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতাকে শ্রদ্ধা করতেন। আজ সেই ঐতিহ্যের রাজ্যে স্কুলে ছাত্র নেই, শিক্ষক অনুপস্থিত, আলো নেই, ভবিষ্যৎ নেই। রাজ্যের জনসংখ্যার মাত্রা ১৪.৭১ শতাংশ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরেয়েছেন।স্নাতক হয়েছেন মাত্র ৭ শতাংশ মানুষ।বিহারের এক-তৃতীয়াংশের কাছাকাছি মানুষ কখনও স্কুল বা কলেজে যাননি। অতএব প্রশ্নটি অবধারিত- যে রাজ্যের এই চিত্র, সেখানে এত তীব্র ক্ষমতার লড়াই কেন? মানুষের মুক্তির জন্য, না নিজের তৃষ্ণা নিবারণের জন্য? যেদিন শিক্ষা ভোটের মূল ইস্যু হবে, সেদিনই হয়তো নালন্দার মাটি আবার আলোর দিকে ফিরবে। তার আগে পর্যন্ত বিহার হয়ে যাবে অন্ধকারে গহ্বরে, রাজনীতির আলোয় ঢাকা এক চির-অশিক্ষিত প্রদেশ। অথচ শিক্ষাই বিহারে অগণিত পরিযায়ী শ্রমিকের রুটি রুজির ভিত্তি হতে পারত। শিক্ষা অনুপস্থিত থাকলে সেই প্রদেশ উন্নয়ন কি অলীক কল্পনা নয়? প্রশ্নটা এখানে রাজনৈতিক নয়- নৈতিক। যেদিন এই প্রশ্নের জবাব দেবে বিহারের রাজনীতি, সেদিনই নালন্দার ধ্বংসস্তূপ থেকে আবার আলো উঠবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *