মধুবনীর গড় অক্ষুণ্ণ রাখতে মরিয়া এনডিএ!!
অনলাইন প্রতিনিধি :-বিহার রাজ্যের উত্তর-পূর্ব অংশে অবস্থিত ‘মধুবনী’ একটি ঐতিহ্যশালী জেলা এবং শহর। এটি ভারতের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র নেপালের সীমান্তবর্তী একটি জেলা। এই জেলা আগে ছিলো দ্বারভাঙ্গা বিভাগের অধীন। ১৯৭২ সালে পুরনো দ্বারভাঙা জেলা ভেঙে মধুবনী নতুন জেলা হিসাবে গঠিত হয়। এই জেলার ঐতিহাসিক পরিচিতও রয়েছে। ঐতিহ্যশালী বিখ্যাত শিল্পকলা শৈলী ‘মধুবনী চিত্রকলা’ বা ‘মিথিলা পেইন্টিং’ এর জন্য এই জেলার পরিচিতি জগৎ জুড়ে। মধুবনী রেলস্টেশনে পা রাখতেই সেই বিখ্যাত শিল্পকলা শৈলী নজরে পড়লো। ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী মধুবনী শিল্প বা মিথিলা চিত্রকলা ঐতিহ্যগতভাবে ভারত এবং নেপালের মিথিলা অঞ্চলের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মহিলারা তৈরি করতেন। সেই ঐতিহ্য এবং পরম্পরা আজও অব্যাহত। বরং এখন এই শিল্পকলার ব্যাপক প্রসারলাভ করেছে। প্রাচীন শিল্পের এই অসাধারণ রূপ এখন প্রায় সর্বত্র দেখা যায়। এই শিল্পকলা এখন আরও পরিমার্জিত হয়ে কাগজে কিংবা ক্যানভাসেও এর বিকাশ ঘটছে। মধুবনী
শহরের পাশে গ্রামগুলিতে গেলেই নজরে পড়বে এই অসাধারণ চিত্রকলার নানা নির্দশন। বিশেষ করে মহিলারা এই শিল্পের সাথে যুক্ত। এমনই একটি গ্রাম জিতোয়ারপুর। গ্রামে গিয়ে দেখা গেলো প্রায় ঘরে ঘরে মহিলারা এই শিল্পকলার সাথে যুক্ত। এই জেলারই বহু শিল্পী জাতীয় পুরস্কার, রাষ্ট্রপতি পুরস্কার, শিল্পগুরু পুরস্কার, পদ্মশ্রী পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন এই মধুবনী চিত্রকলার জন্য। এরমধ্যে জিতোয়ারপুর গ্রামেতো প্রায় ঘরে ঘরে জাতীয় এবং রাষ্ট্রপতি পুরস্কার প্রাপ্তদের ছড়াছড়ি। মধুবনী শাড়ি আজ ভারত বিখ্যাত।
জেলার লোকসংখ্যা বর্তমানে পঞ্চাশ লক্ষের উপর। এই জেলার অন্তর্ভুক্ত দুটি লোকসভা কেন্দ্রে রয়েছে। সেগুলো হলো ‘মধুবনী এবং ‘ঝাঁঝাড়পুর’। এই দুটি লোকসভা কেন্দ্রে রয়েছে দশটি বিধানসভা নির্বাচনি ক্ষেত্র। বিধানসভা কেন্দ্রগুলি হলো, হারলাখি, বেনিপট্রি, খাজৌলি, বাবুবাড়ি, বিসফি, মধুবনী, রাজনগর (এসসি), ঝাঁঝাড়পুর, ফুলপাড়া এবং লাউকাহা। জেলার স্বাক্ষরতার হার ৬৫ শতাংশ। মধুবনী হলো বিহারের বৃহত্তম মাছ উৎপাদনকারী জেলা। স্থানীয় জনগণের বক্তব্য,জেলার যোগাযোগ ব্যবস্থা ও পরিকাঠামো আগের তুলনায় অনেক ভালো হয়েছে।শিক্ষা ব্যবস্থা ও পরিকাঠামো আগের তুলনায় উন্নতি হয়েছে। ছয়টি জাতীয় সড়ক জেলার পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থাকে অনেকটা উন্নত করেছে। তবে রোজগার, বেকারত্ব, পলায়ন, কর্মসংস্থান ইত্যাদি নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ও সমস্যা আছে। জেলার মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮২ শতাংশ হিন্দু, ১৭শতাংশ মুসলিম এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের ১ শতাংশ। জনসংখার মাত্র ৪ শতাংশ মানুষ শহরে বসবাস করেন।৯৬ শতাংশই বসবাস করেন গ্রামীণ এলাকায়।জেলার জনসংখ্যার প্রায় ৮৫ শতাংশ মানুষ মৈথিলী ভাষাভাষী। উর্দু ভাষী ১২ শতাংশ, হিন্দি ভাষী ৩ শতাংশ। জনসংখ্যার প্রায় ১৪ শতাংশ তপশিলি জাতি গোষ্ঠীর এবং ১ শতাংশ তপশিলি উপজাতি গোষ্ঠীর। জেলার মূল অর্থনীতি কৃষি হলেও, এখানকার মধুবনী শিল্পকলা গ্রামীণ অর্থনীতিকে অনেকটা মজবুত এবং ভরসা জোগাচ্ছে।এবার জেলার রাজনৈতিক ইতিহাসের দিকে নজর দেওয়া যাক। জেলার দুটি লোকসভা কেন্দ্র। একটি ‘মধুবনী’ অন্যটি ঝাঁঝাড়পুর’। দুটি লোকসভা কেন্দ্রই এনডিএ জোটের দখলে।মধুবনী বিজেপির দখলে এবং ঝাঁঝাড়পুর জেডিইউ’র দখলে। মধুবনী লোকসভা কেন্দ্র থেকে এর আগে ছয় বার করে জয়ী হয়েছিল কংগ্রেস এবং সিপিআই প্রার্থী। সেই ইতিহাস এখন অতীত। মাঝে একবার জনতা পার্টি এবং এরপর পাঁচ বার এই কেন্দ্র থেকে জয়ী হয়েছে বিজেপি প্রার্থী। ১৯৭৭ সালে এই মধুবনী লোকসভা কেন্দ্র থেকে জনতা পার্টির প্রার্থী হিসাবে জয়ী হয়ে সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন হুকুমদের নারায়ণ যাদব। সেই হুকুমদেব পরবর্তীকালে বিজেপি দলে যোগ দেন। ১৯৯৯ সালে তিনি এই কেন্দ্র থেকে বিজেপি প্রার্থী হিসাবে জয়ী হয়ে পুনরায় সংসদে যান। মাঝে ২০০৪ সালে তিনি এই কেন্দ্রে কংগ্রেস প্রার্থীর কাছে সামান্য ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়েছিলেন। এরপর পুনরায় ২০০৯,২০১৪ সালে পর পর দুইবার এই কেন্দ্র থেকে বিজেপি প্রার্থী হিসাবে জয়ী হয়ে সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০১৯ এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্র থেকে তার পুত্র অশোক কুমার যাদব জয়ী হয়ে আসছেন। এককথায়, টানা দুই দশক ধরে মধুবনী লোকসভা কেন্দ্রটি বিজেপির দখলে রয়েছে। অন্যদিকে, জেলার ঝাঁঝাড়পুর লোকসভা কেন্দ্র ১৯৭৭ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত, জেডিইউ ৭ বার, আরজেডি ২ বার এবং ১ বার করে জয়ী হয়েছিলেন বিজেপি ও কংগ্রেস প্রার্থী। ২০১৪ সালে বিজেপি প্রার্থী বীরেন্দ্র কুমার চৌধুরী এই কেন্দ্র থেকে জয়ী হয়েছিলেন। ২০১৯ এবং ২০২৪ পরপর দুইবার এই কেন্দ্র থেকে জয়ী হয়েছেন জেডিইউ প্রার্থী রামপ্রীত মণ্ডল। জেলার অন্তর্ভুক্ত দশটি বিধানসভা আসনের নির্বাচনি ফলাফলের পরিসংখ্যানও প্রায় একইরকম। দশটি বিধানসভা আসনের মধ্যে ৮ টি এনডিএ জোটের দখলে। ২ টি বিধানসভা আরজেডি’র দখলে। এনডিএ- এর ৮ টির মধ্যে ৫ টি বিজেপি এবং ৩টি জেডিইউ। জেলার এই রাজনৈতিক ইতিহাস এবং ভোটের ফলাফলের পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট, মধুবনী জেলা এনডিএ জোটের অন্যতম গড়। এতে কোনও সন্দেহ নেই। স্থানীয় জনগণের সাথে কথা বলে যতটুকু আভাস পাওয়া গেছে, তাতে এবারও বিধানসভা ভোটের ফলাফলে তেমন কোনও পরিবর্তন হবে বলে মনে হয় না। এক-দুটি বিধানসভা আসনে এদিক সেদিক হতে পারে। তবে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, মধুবনীতে প্রশান্ত কিশোরের নব গঠিত দল জন সুরাজ পার্টির কয়েকটি প্রচার গাড়ি নজরে পড়েছে। গাড়িগুলি সকাল থেকে রাত পর্যন্ত শহর থেকে গ্রামের রাস্তা, অলি গলিতে সাউন্ড বক্স লাগিয়ে ভোটের প্রচার করে যাচ্ছে। অন্য দলের প্রচার গাড়িও আছে। আগামী ১১ নভেম্বর শেষ দফায় ১২২ টি আসনের সাথে মধুবনী জেলার দশটি বিধানসভা আসনেও ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু এখানেও সেই ছবি। স্থানীয় জনগণের মধ্যে হাইভোল্টেজ বিধানসভা নির্বাচন নিয়ে তেমন কোনও তাপ উত্তাপ নেই। উৎসাহ উদ্দীপনা তো দূরের কথা। সাধারণ মানুষ যে যার কাজে ব্যস্ত। ২০২৫ বিধানসভা নির্বাচনে এই জেলায় আসন বণ্টন নিয়ে শাসক-বিরোধ দুই প্রধান জোটের কারোর কোনও সমস্যা নেই। জেলার দশটি আসনের মধ্যে এনডিএ জোটের বিজেপি লড়াই করবে পাঁচটি বিধানসভা কেন্দ্রে। কেন্দ্রগুলি হলো, বেনিপট্টি, খাজোলি, বিসফি, রাজনগর (এসসি), এবং ঝাঁঝাড়পুর আসনে। জেডিইউ লড়াই করবে চারটি কেন্দ্র। কেন্দ্রগুলি হলো, হরখালি, বাবুবাড়ি, ফুলপাড়া এবং লাউকাহা আসনে। একটি আসন মধুবনী কেন্দ্রে এবার লড়াই করবে আরএলএম প্রার্থী। অপরদিকে মহাজোটের আরজেডি লড়াই করবে ছয়টি আসনে। কেন্দ্রগুলি হলো, খাজৌলি, বাবুবাড়ি, বিসফি, মধুবনী,রাজনগর (এসসি), এবং লাউকাহা। কংগ্রেস লড়াই করবে বেনিপট্টি, ও ফুলপাড়া এই দুটি আসনে। সিপিআই লড়াই করবে হরখালি ও ঝাঁঝাড়পুর এই দুটি আসনে। এবার বিধানসভা নির্বাচনে ‘হরখালি’ বিধানসভা কেন্দ্র থেকে এনডিএ জোটের প্রার্থী গতবারের জয়ী জেডিইউ বিধায়ক সুধাংশু শেখর। দল এবারও তাকে টিকিট দিয়েছে। অন্যদিকে মহাজোটের সিপিআইপ্রার্থী নতুন মুখ রাকেশ কুমার পাণ্ডে। এই কেন্দ্রে গতবারে বিজিত সিপিআই প্রার্থী রাম নরেশ পাণ্ডেকে দল এবার টিকিট দেয়নি। ‘বেনিপট্টি’ বিধানসভা আসনে এনডিএ জোটের বিজেপি প্রার্থী গতবারের জয়ী বিধায়ক বিনোদ নারায়ণ ঝা। এই আসনে মহাজোটের প্রার্থী কংগ্রেসের নতুন মুখ নলিনী রঞ্জন ঝা। গতবারের বিজিত প্রার্থী ভাবনা ঝা’কে দল এবার টিকিট দেয়নি। ‘খাজৌলি’ বিধানসভা কেন্দ্রে এনডিএ জোটের প্রার্থী গতবারে জয়ী বিধায়ক অরুণ শংকর প্রসাদ। দল এবারও তাকে টিকিট দিয়েছে। এই কেন্দ্রে মহাজোটের আরজেডি প্রার্থী নতুন মুখ ব্রজ কিশোর যাদব। গতবারের বিজিত প্রার্থী সীতারাম যাদবকে দল এবার টিকিট দেয়নি। ‘বাবুবাড়ি বিধানসভা কেন্দ্রে এনডিএ জোটের প্রার্থী গতবারের জয়ী জেডিইউ বিধায়িকা মীনা কুমারী। তিনি এবারও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এই কেন্দ্রে মহাজোটের আরজেডি প্রার্থী গতবারে প্রার্থী নতুন মুখ অরুণ কুশওয়াহা। গতবারের বিজিত প্রার্থী উমাকান্ত যাদবকে দল এবার টিকিট দেয়নি। ‘বিসফি’ বিধানসভা আসনে এবার এনডিএ জোটের বিজেপি প্রার্থী গতবারের জয়ী বিধায়ক হরিভূষণ ঠাকুর। দল এবারও তার উপর আস্থা রেখেছে। অপরদিকে, মহাজোটের আরজেডি প্রার্থী নতুন মুখ আসিফ আহমেদ। গতবারের বিজিত প্রার্থী ফাইয়াজ আহমেদকে দল এবার টিকিট দেয়নি। ‘মধুবনী’ কেন্দ্রে এবার এনডিএ জোটের আরএলএম দলের প্রার্থী মাধব আনন্দ। অন্যদিকে মহাজোটের আরজেডি প্রার্থী গতবারের জয়ী বিধায়ক সমীর কুমার মহাশেঠ। রাজনগর (এসসি) আসনে এনডিএ জোটের বিজেপি প্রার্থী নতুন মুখ সুজিত পাসওয়ান। এই কেন্দ্র থেকে গতবারের জয়ী বিধায়ক রামপ্রীত পাসওয়ানকে দল এবার টিকিট দেয়নি। এই কেন্দ্রটি থেকে এবার মহাজোটের আরজেডি প্রার্থী নতুন মুখ বিষ্ণুদেও মোচি। গতবারের বিজিত প্রার্থী রামাওতার পাসওয়ানকে দল এবার টিকিট দেয়নি। ‘ঝাঝাড়পুর’ কেন্দ্রে থেকে এনডিএ জোটের বিজেপি প্রার্থী গতবারের জয়ী বিধায়ক নীতীশ মিশ্র এবারও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। অন্যদিকে মহাজোটের সিপিআই প্রার্থী গতবারের বিজিত প্রাথী রাম নারায়ণ যাদব। ‘ফুলপাড়া’ আসনে এনডিএ জোটের জেডিইউ প্রার্থী গতবারের জয়ী বিধায়িকা শীলা কুমারী এবারও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এই কেন্দ্রে মহাজোটের কংগ্রেস প্রার্থী নতুন মুখ সুবোধ মণ্ডল। গতবারের বিজিত প্রার্থী কৃপানাথ পাঠককে এবার টিকিট দেয়নি দল। ‘লাউকাহা’ আসনে এনডিএ জোটের জেডিইউ প্রার্থী নতুন মুখ সতীশ কুমার শাহ। গতবারের বিজিত প্রার্থী লক্ষেশ্বর রাম এবার টিকিট পায়নি। অন্যদিকে মহাজোটের আরজেডি প্রার্থী গতবারের জয়ী বিধায়ক ভারত ভূষণ মণ্ডলকে দল এবারও টিকিট দিয়েছে। মধুবনী জেলাতেও মূলত লড়াই দ্বিমুখী হতে যাচ্ছে। তৃতীয় শক্তি হিসেবে আছে জন সুরাজ পার্টি। স্থানীয় মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ও মনোভাব লক্ষ্য করা গেছে। সরকারের বিরুদ্ধে একাংশ মানুষের ক্ষোভ থাকলেও, সরকার পরিবর্তন হাওয়ার মতো মনে হয়নি। তবে শেষ পর্যন্ত কি হয়, সেটা জানতে গণনা পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে।