গিরিরাজের খাসতালুকে লড়াই হবে দ্বিমুখী!!
অনলাইন প্রতিনিধি :-বিহার রাজ্যের ৩৮টি জেলার মধ্যে বেগুসরাই হলো একটি। এই জেলাটি বিহারের মিথিলা অঞ্চল এবং মুঙ্গের বিভাগের অন্তর্ভুক্ত। ১৯৭২ সালে বেগুসরাই পৃথক জেলা হিসাবে স্বীকৃতি পায়। এই জেলায় একটিই লোকসভা কেন্দ্র। আর সেটি হচ্ছে ‘বেগুসরাই’। জেলার লোকসংখ্যা প্রায় পঁয়ত্রিশ লক্ষ। গঙ্গা নদীর উত্তর তীরে অবস্থিত বিহারের এই জেলা ও শহর নানা দিক থেকে প্রসিদ্ধ। এখানেই রয়েছে এশিয়ার বৃহত্তম পাখি অভায়ারণ্য, যা ‘কানওয়ার লেক’ নামে পরিচিত। শুধু তাই নয়, বেগুসরাই বিহার রাজ্যের অন্যতম শিল্পাঞ্চল হিসেবে খ্যাত। ‘বারাউনি’ জেলার প্রধান শিল্প শহর। এই শহরেই রয়েছে দেশের অন্যতম তেল শোধনাগার ‘রারাউনি রিফাইনারি’, দেশের অন্যতম বৃহৎ তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র ‘বারাউনি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র’।রয়েছে রাসায়নিক কারখানা, রয়েছে বৈদ্যুতিক লোকোমোটিভ ইঞ্জিন তৈরির কারখানা,রয়েছে পেপসি বোতলজাতকরণ কারখানার মতো বৃহৎ শিল্প। এগুলোকে কেন্দ্র করে রয়েছে আরও পাঁচশোর অধিক ছোট, মাঝারি ও বড় অনুসারি শিল্প কারখানা। এখানেই শেষ নয়, বেগুসরাই ভারতবর্ষের বৃহত্তম দুধ গ্রহণকারী এবং উৎপাদনকারী জেলাগুলির মধ্যে একটি। সুধা ডেয়ারি প্ল্যান্ট সমগ্র বিহার জুড়ে দুধের বৃহত্তম রপ্তানিকারকদের মধ্যে একটি। বেগুসরাই এসে এর বাস্তবতা লক্ষ্য করলাম। এই জেলায় বসবাসকারী প্রায় প্রতিটি পরিবারে রয়েছে একাধিক গৃহপালিত গরু এবং মহিষ। যা মানুষের চাইতেও বেশি যত্নে লালন পালন হচ্ছে। অর্থনীতির মূল ভিত্তি কৃষি হলেও, এখানকার দুগ্ধ শিল্প এবং বিভিন্ন ফল উৎপাদন জেলার গ্রামীণ অর্থনীতিকে মজবুত করেছে এবং জেলাকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। জেলার যোগাযোগের ব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থা আগের তুলনায় অনেকটাই এগিয়ে গেছে।এনিয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। আইনশৃঙ্খলার অবস্থাও অনেক ভালো। আমাদের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে যে পাঁচ কোম্পানি টিএসআর জওয়ান বিহারে নির্বাচনে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করতে এসেছে, তাদের সকলকেই এই বেগুসরাই জেলাতেই মোতায়েন করা হয়েছে। এখানে এসেই নজরে পড়লো বিভিন্ন জায়গায় টিএসআর জওয়ানরা টহল দিচ্ছেন। রাস্তায় অনেক জওয়ানদের সাথে কথা বললাম। সকলেরই একটা কথা, এখানে রাজনীতি নিয়ে কোনও হিংসা হানাহানি নেই। এক কথায় কোনও টেনশন বা উত্তেজনা নেই। এখানে কোনও মিছিল নেই। রাস্তা আটকে পথসভা নেই। যার নেতৃত্বে পাঁচ কোম্পানি টিএসআর জওয়ান বিহার এসেছে, কমান্ডেন্ট জ্যোতিস্নান দাস চৌধুরী, তার সাথেও কথা হলো। তিনিও একই কথা বললেন। বললেন, এখানে সাধারণ মানুষ সকলে কাজ নিয়ে ব্যস্ত।ফলে পরিস্থিতি ‘একেবারেই স্বাভাবিক ও শান্তিপূর্ণ। সাধারণ জনগণের মধ্যে রাজনীতি নিয়ে একেবারেই কোনও তাপ উত্তাপ নেই। আমাদের রাজ্যে যেটা অকল্পনীয়। ফলে আমাদেরও তেমন কোনও চাপ নেই।
এটা ঠিক যে, গোটা বিহারে কোথাও নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আমাদের ত্রিপুরা রাজ্যের মতো, মিছিল, পথসভা, উঠান সভা, বুথ সভা, বাড়ি বাড়ি প্রচার ইত্যাদি কিছুই নেই। এমন কি রাস্তা ঘাটে কোথাও কোনও রাজনৈতিক দলের ফ্ল্যাগ, পোস্টার, দেওয়াল লিখন, ফ্ল্যাক্স, ফেস্টুন, হোর্ডিং, ডিসপ্লে ইত্যাদি প্রচারসজ্জা নেই। বাইরে থেকে দেখে বোঝার কোনও উপায় নেই যে এখানে বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। প্রচার বলতে শুধু নির্বাচন কমিশনের সচেতনতা প্রচার। জনগণকে তাদের সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার প্রয়োগ করে সরকার গঠনে অংশ নেওয়ার আবেদন জানিয়ে প্রচার। রাজনৈতিক দলের প্রচার বলতে বড় এলাকায় জনসভা, রোড শো এবং ছোট যানবাহনে (অটো, টমটম, ছোট গাড়ি) মাইক কিংবা সাউন্ড বক্স লাগিয়ে ভোট দেওয়ার আবেদন। বাহ্যিক প্রচার বলতে এটুকুই। তবে ডিজিটাল প্রচার আছে। ডিজিটাল প্রচারই সবথেকে বেশি। একটা কথা বলতেই হবে, রাজনীতির দৃশ্যদূষণ নেই বললেই চলে। প্রথম পর্যায়ের ভোটে আজ বিকেল চারটায় সরব প্রচার শেষ হয়েছে। বেগুসরাই জেলাতেও আগামী ছয় নভেম্বর ভোট অনুষ্ঠিত হবে। এই জেলায় রয়েছে সাতটি বিধানসভা কেন্দ্র। এগুলি হলো, ১৪১নং চেরিয়া-বারিয়ারপুর, ১৪২নং বাছওয়ারা, ১৪৩নং তেঘরা, ১৪৪নং মাতিহানি, ১৪৫নং সাহেবপুর কামাল, ১৪৬নং বেগুসরাই এবং ১৪৭নং বাখরি। এই জেলার রাজনৈতিক ইতিহাস এবং রাজনৈতিক সমীকরণও বেশ চমকপ্রদ। এই জেলার একটি মাত্র লোকসভা কেন্দ্র ‘বেগুসরাই’ গত পনের বছর ধরে ভারতীয় জনতা পার্টির দখলে। এই বেগুসরাই লোকসভা কেন্দ্রেরই সাংসদ বিজেপির হেভিওয়েট নেতা বর্তমান মোদি সরকারের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গিরিরাজা সিং। ২০১৯ এবং ২০২৪ পরপর দুইবার এই কেন্দ্র থেকেই বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছেন বিজেপির বরিষ্ঠ নেতা গিরিরাজ সিং।২০১৯ সালে তিনি প্রাক্তন বাম যুব নেতা কানাইয়া কুমারকে চার লক্ষের বেশি ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে জয়ী হয়েছিলেন। কানহাইয়া কুমার ওই বছর সিপিআই দলের প্রার্থী হিসেবে লড়াই করেছিল। তার আগে ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনেও বেগুসরাই কেন্দ্র থেকে বিজেপি প্রার্থী ভোলা সিং জয়ী হয়েছিলেন। তারও আগে ২০০৯ এবং ২০০৪ বেগুসরাই লোকসভা কেন্দ্র ছিলো জনতা দল ইউনাইটেডের দখলে। সর্বশেষ ১৯৯৯ সালে কংগ্রেস প্রর্থী এই কেন্দ্র থেকে জয়ী হয়েছিলেন। ১৯৯৯ এরপর থেকে কংগ্রেস আর এই কেন্দ্রে দাঁত ফোটাতে পারেনি। ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনে বেগুসরাই লোকসভা কেন্দ্রে দ্বিতীয় স্থান পায় সিপিআই প্রার্থী আবধেশ কুমার রায়। ফলে রাজনৈতকি শক্তির বিচারে বেগুসরাই লোকসভা কেন্দ্রটিতে বিজেপির রমরমা হলেও, এখানে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিআই) পরম্পরাগত একটা প্রভাব ও শক্তি রয়েছে। যে কারণে এই লোকসভা কেন্দ্রের অধিন সাতটি বিধানসভা আসনের মধ্যে ‘তেঘরা’ এবং ‘বাখরি’ এই দুটি আসন বর্তমানে সিপিআইয়ের দখলে। ‘বাছওয়ারা’ এবং ‘বেগুসরাই’ এই দুটি বিধানসভা কেন্দ্র বর্তমানে বিজেপির। আরজেডির দখলে রয়েছে ‘চেরিয়া-বারিয়ারপুর’ এবং ‘সাহেবপুর কামাল’ এই দুটি বিধানসভা আসন। এলজিপি (রামবিলাস) এর দখলে রয়েছে ‘মাতিহানি’ বিধানসভা আসনটি। ফলে এখানেও লোকসভা এবং বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল এবং রাজনৈতিক সমীকরণের মধ্যে একটা ভিন্নতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কিন্তু সাতটি বিধানসভা আসনের মধ্যে দুটি আসনে ২০২০ তে জয় পরাজয়ের মার্জিন ছিলো খুবই সামান্য। সিপিআই এবং আরজেডি প্রার্থী জয়ী হয়েছিলেন যথাক্রমে ৪৮৪ এবং ৩৩৩ ভোটের ব্যবধানে।
এবার ২০২৫ নির্বাচনে এই জেলাতেও সাতটি আসনের মধ্যে একটি আসনে মহাজোটের আসন সমঝোতা হয়নি। এই আসনটিতে কংগ্রেস ও সিপিআই দুই দলের প্রার্থীই লড়াই করছে। বাকী ছয়টির মধ্যে আরজেডি প্রার্থী লড়ছে তিনটি আসনে। সিপিআই লড়ছে দুটি আসনে। একটি আসনে কংগ্রেস। অপরদিকে এনডিএ জোটের আসন ভাগাভাগি নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। সাতটির মধ্যে বিজেপি লড়াই করবে তিনটি আসনে।জেডিইউ এবং এলজিপি লড়াই করবে দুটি করে আসনে। এখানে একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, ২০২০ সালে নির্বাচনে ‘মাতিহানি’ আসনে জেডিইউ প্রার্থী নরেন্দ্র কুমার সিংকে হারিয়ে জয়ী হয়েছিলেন এলজিপি প্রার্থী রাজকুমার সিং। আসন বণ্টনে এই কেন্দ্রটি এবার জেডিইউকে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বিধায়ক রাজকুমার সিং এবার জেডিইউ প্রার্থী হিসেবে এই কেন্দ্রে লড়াই করবেন। অপরদিকে বিজিত প্রার্থী ক্ষুব্ধ জেডিইউ নেতা নরেন্দ্র কুমার সিং আরজেডি দলে যোগ দিয়েছেন। তিনি এবার আরজেডির টিকিটে মাতিহানি আসন থেকে লড়াই করবেন। এছাড়া এবার চেরিয়া-বারিয়ারপুর আসনে এনডিএ জোটের জেডিইউ প্রার্থী নতুন মুখ অভিষেক কুমার। গতবারের বিজিত প্রার্থী মঞ্জু ভার্মাকে দল এবার টিকিট দেয়নি। অপরদিকে মহাজোটের আরজেডি প্রার্থী নতুন মুখ সুশীল কুমার। এই আসনে গতবারের জয়ী বিধায়ক রাজবংশী মাহাতোকে দল টিকিট দেয়নি। বাছওয়ারা কেন্দ্রে এনডিএ জোটের প্রার্থী গতবারের জয়ী বিজেপি বিধায়ক সুরেন্দ্র মেহতাকে দল এবারও টিকিট দিয়েছে।অপরদিকে এই কেন্দ্রে মহাজোটের কংগ্রেস প্রার্থী শিব প্রকাশ গরীব দাস এবং সিপিআই এর গতবারের বিজিত প্রার্থী অবধেশ কুমার রায়। তেঘরা আসনে এনডিএ জোটের বিজেপি প্রার্থী রজনীশ কুমার সিং। এই আসনে গতবার জেডিইউ প্রার্থী লড়াই করেছিল। অপরদিকে মহাজোটের সিপিআই প্রার্থী গতবারের জয়ী বিধায়ক রাম রতন সিং এবারও লড়াই করবেন। সাহেবপুর কামাল আসনে এনডিএ জোটের এলজিপি প্রার্থী সুরেন্দ্র কুমার। গতবার এই কেন্দ্র থেকে জেডিইউ প্রার্থী শশীকান্ত কুমার শশী লড়াই করেছিলেন। আসন বণ্টনে এবার এই আসনটি জোট শরিক এলজিপির কাছে গেছে। এই আসনে মহাজোটের প্রার্থী গতবারের জয়ী আরজেডি বিধায়ক সদানন্দ সম্মুদ্ধ। বেগুসরাই বিধানসভা আসনে এনডিএ জোটের বিজেপি প্রার্থী গতবারের জয়ী বিজেপি বিধায়ক কুন্দন কুমার। তিনি বেগুসরাইয়ের বিজেপির অত্যন্ত প্রভাবশালী এবং জনপ্রিয় নেতা বলে পরিচিত। অপরদিকে মহাজোটের গতবারের বিজিত কংগ্রেস প্রার্থী অমিতা ভূষণ এবারও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। বাখরি (এসসি) এই আসনে এনডিএ জোটের এলজিপি প্রার্থী নতুন মুখ সঞ্জয় পাসোয়ান। এই আসনে গতবার বিজেপি প্রার্থী রামশঙ্কর পাসোয়ান লড়াই করেছিলেন। আসন বন্টনে এই আসনটি এবার এলজিপিকে দেওয়া হয়েছে। অপরদিকে মহাজোটের প্রার্থী গতবারের জয়ী বিধায়ক সিপিআই-এর সূর্যকান্ত পাসোয়ান।
এছাড়াও প্রতিটি কেন্দ্রে এবার তৃতীয় শক্তি জন সুরাজ পার্টির প্রার্থীরা রয়েছেন। তবে সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলে যতটুকু আভাস পাওয়া গেছে, প্রশান্ত কিশোরের দল এখানেও কিছু ভোট কাটা ছাড়া, কাজের কাজ কিছুই করতে পারবে না। বেগুসরাই জেলায় মূলত দ্বিমুখী লড়াই হবে। এনডিএ জোটের পাল্লা ভারী হলেও, এক-দুটি আসনে টক্কর হবে জমজমাট। এনিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। গত পাঁচ বছরে জেলার এবং গ্রামীণ এলাকায় ভালোই উন্নয়ন হয়েছে বলে স্থানীয়দের দাবি। আমরাও দেখলাম, শহরে নতুন আট লেনের সড়কের পাশাপাশি বিশাল বড় উড়ালপুল নির্মাণের কাজ চলছে। ছয় নভেম্বর ভোটগ্রহণ। কাল সকাল থেকে ভোট কর্মীরা ভোট সামগ্রী নিয়ে বুথে বুথে যাওয়া শুরু করবেন।