রঞ্জিতবাবু জেনেভা গিয়েছিলেন,কোন দেশের পাসপোর্টে? জানতে চায় ত্রিপুরাবাসী!!
রাজনীতির জালে চুক্তি!!
ভারত-আমেরিকা বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে গত কয়েক মাস ধরে যা চলছে, তা নিছক অর্থনৈতিক দর কষাকষি নয়-এ এক বহুপর্দার রাজনৈতিক নাটক। সামনের সারিতে দেখা যাচ্ছে শুল্ক হারের লড়াই, কিন্তু পর্দার আড়ালে স্পষ্টতই চলছে দুই রাষ্ট্রনেতার নিজ নিজ স্বার্থের খেলা। নয়াদিল্লী এবং ওয়াশিংটনের কূটনৈতিক ভাষায় যেটিকে ইতিবাচক আলোচনা বলা হচ্ছে, সেটি বাস্তবে যেন ‘অপেক্ষার রাজনীতি।’
গত মে মাসে যখন বাণিজ্যচুক্তি নিয়ে আলোচনা নতুন আশার আলো দেখিয়েছিল, তখন আমেরিকা ভারতীয় পণ্যে ১৫ শতাংশ শুল্কে রাজি হয়ে যায়। কিন্তু নয়াদিল্লী তখনই আরও দর কষাকষি শুরু করে-চায় শুল্ক নামুক ১০ শতাংশে, কারণ ট্রাম্প প্রশাসনের আগের বাড়তি শুল্ক আরোপের আগে সেটিই ছিল স্বাভাবিক হার। ভারতের উদ্দেশ্য ছিল, দেশীয় শিল্পকে কিছুটা সুরক্ষা দেওয়া এবং আমেরিকার বাজারে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান ধরে রাখা।
কিন্তু এই চাপের পাল্টা উত্তর আসে ওয়াশিংটন থেকে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তখন রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধ করতে ভারতের প্রতি আরও কঠোর অবস্থান নেন। অর্থাৎ, বাণিজ্যচুক্তি এবং ভূরাজনীতির কার্ড একসঙ্গে খেলতে শুরু করেন তিনি। এর ফল-চুক্তি কার্যত স্থবির হয়ে পড়ে। পাঁচ মাস পরে আজ আবার দুই দেশ আলোচনার টেবিলে ফিরেছে। ১৫ শতাংশ শুল্কের প্রস্তাব আবারও সামনে, তবে এবার সরকারি সূত্র বলছে-আলোচনা ‘ইতিবাচক’। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমেরিকা কেন হঠাৎই এতটা নমনীয়? ২৫ শতাংশ শুল্ক কমিয়ে ১৫ শতাংশে নামানো মানে তো এক প্রকার ছাড়। বিনিময়ে নিশ্চয়ই কিছু চাইছে ওয়াশিংটন। কৃষিপণ্য রপ্তানিতে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ দেশ আমেরিকা চায়, ভারতের দরজা খুলে যাক তাদের ভুট্টা, সয়াবিন, ডেয়ারি ও গমের জন্য। মার্কিন কৃষি লবির চাপও প্রবল। তারা জানে-ভারতের ১৪০ কোটির বাজারে ঢুকতে পারলে তাদের কৃষিখাত নতুন দিগন্ত পাবে।বিশেষত ডেয়ারি ও ভুট্টার ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ সর্বাধিক।
ভারত এ বিষয়ে দৃঢ়।নয়াদিল্লীর অবস্থান- ডেয়ারি খাতে কোনো আপস নয়। কারণ, কোটি কোটি ক্ষুদ্র দুগ্ধচাষি এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। বিদেশি দুধ ও দই বাজারে এলে ভারতের গ্রামীণ অর্থনীতিতে ভয়াবহ আঘাত লাগবে। তবে ভুট্টার ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান তুলনামূলক নমনীয়।
কেন্দ্রীয় সরকারের যুক্তি, ধানের বদলে ভুট্টা থেকে ইথানল উৎপাদন করলে তা তিনদিক থেকেই লাভজনক- পরিবেশবান্ধব জ্বালানি উৎপাদন, কৃষকের আয়ের বিকল্প উৎস এবং জলব্যবস্থার উন্নত ব্যবহারের সম্ভাবনা। কিন্তু বাস্তব সমস্যা হলো- ভারতের পর্যাপ্ত ভুট্টা উৎপাদন নেই। আরও উৎপাদন বাড়াতে গেলে প্রচুর জলের প্রয়োজন, যা ভারতের বর্তমান জলসম্পদের সীমাবদ্ধতায় প্রায় অসম্ভব। তাই আমেরিকা যদি কম দামে ভুট্টা রপ্তানি করতে চায়, তা ভারতের পক্ষে অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হতে পারে। অর্থনীতির ভাষায় সবকিছু যুক্তিযুক্ত মনে হলেও চুক্তি আটকে আছে রাজনৈতিক সমীকরণের জালে। কারণ, ট্রাম্প এবং মোদি- দুজনেই এই চুক্তি নিজেদের রাজনৈতিক অর্জন হিসেবে ব্যবহার করতে চান।
ট্রাম্প যদি ঘোষণা করেন যে ভারত তাঁর শর্তে নত হয়েছে, তাহলে তা আমেরিকার ভোটারদের কাছে এক ‘কূটনৈতিক জয়’ হিসেবে ধরা হবে।কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে সেটিই হয়ে উঠবে রাজনৈতিক বিপর্যয়, বিশেষত বিহারের নির্বাচনের মুখে।
মোদির ভাবমূর্তি ‘শক্তিশালী, আপসহীন নেতা’ হিসেবে গড়ে উঠেছে। যদি দেখা যায় ট্রাম্পের শর্ত মেনে তিনি চুক্তি করেছেন, তাহলে বিরোধীরা সেটিকে হাতিয়ার বানাবে। বিহারে এনডিএর জন্য তা বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে। আবার বিপরীতে, যদি যুক্তি স্থগিত থাকে, ভোট শেষে মোদি সেটিকে নিজের সুবিধামতো রূপ দিতে পারবেন- ‘আমেরিকাকেও আমরা শর্ত মানাতে পেরেছি।’
অর্থাৎ চুক্তি ঝুলে থাকা এখন একেবারে রাজনৈতিকভাবে প্রয়োজনীয়। অর্থনীতি এখানে গৌণ, রাজনীতি প্রধান।
এই স্থবিরতা কেবল দ্বিপাক্ষিক নয়-এর প্রভাব পড়ছে বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক পরিসরে। রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধ না করলে আমেরিকা ভারতের ওপর চাপ বাড়াতে পারে। ফলে, ভারতের জ্বালানি নীতিতে প্রভাব, পড়বে, বিশেষত যখন দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা ক্রমেই আমদানিনির্ভর হয়ে উঠছে। একইসঙ্গে, চিন- আমেরিকা বাণিজ্যযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ভারত এখন এক সম্ভাবনায় বিকল্প বাজার। ওয়াশিংটন সেই সুযোগ হাতছাড়া করতে চায় না।
সব মিলিয়ে, ভারত-আমেরিকা বাণিজ্যচুক্তি এখন এমন এক অবস্থায় পৌঁছেছে, যেখানে সংখ্যার অঙ্ক নয়, ভোটের অঙ্কই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যে চুক্তি উভয় দেশের অর্থনীতি, শিল্প ও কৃষি-উৎপাদনে নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারত, তা আজ পরিণত হয়েছে ক্ষমতার পরীক্ষাক্ষেত্রে।
অর্থনীতির সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক চিরকালই জটিল ছিল, কিন্তু এবার তা স্পষ্টতই পরিণত হয়েছে ‘অর্থনীতির অবরোধে রাজনীতির জয়’-এ।চুক্তি যখনই হোক, এই সত্যটি অনস্বীকার্য- ভারতের বাজার নিয়ে বিশ্বশক্তির টানাপোড়েন এখন আর নিছক বাণিজ্যের নয়, বরং ভূরাজনৈতিক ক্ষমতার প্রতিযোগিতা।