বাংলাদেশের সনদ

বাংলাদেশে ছাত্রদের আন্দোলন বা হাসিনা সরকার উতখাতের পর প্রতিষ্ঠিত সরকারের উপর দায়িত্ব ছিল জুলাই সনদ তৈরির। আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে নিষিদ্ধ। এই দল বাদে জুলাই সনদে মোটামুটি সব দলই স্বাক্ষর করেছে। তবে যে সব তরুণকে শান্ত করতে ইউনুস সরকার সংস্কারর ও সনদ শুরু করেছিল, তাঁরাই স্বাক্ষর করেননি। তাঁরা এখন পর্যন্ত অশান্তই রয়ে গেলেন। তবু স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের পর মোটামুটি স্বস্তির আবহ। নির্বাচনে যেতে এখন আর বাধা নেই ইউনুস সরকারের জন্য। এক বছরে জুলাই সনদ নিয়ে কম কসরত হয়নি। মনে হচ্ছিল, কাজটি করতে না পারলে বাংলাদেশে নির্বাচন, সরকার, রাজনীতি সব অচল হয়ে যাবে।
সনদের এতসব ধারা-উপধারা, কে কোনটি মানল, কোনটি কখন বাদ গেল, আবার কখন কোনটি সংশোধন করা হলো-এসবের হদিশ রাখা কঠিন হয়ে উঠেছিল সেই দেশের মানুষের জন্য। বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলো মাঝে মাঝেই সনদ নিয়ে এতোটাই ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল যে মনে হতো তাদের দেশে আর কোনও সমস্যা নেই। সনদ পাস হয়ে গেলেই বুঝি সব সমস্যার হাল হয়ে যাবে। বাংলাদেশের জুলাই সনদ নিয়ে তিনটি অধ্যায় পার করতে দেখা গেছে। তিনটি অধ্যায় হল, প্রথমত, সনদে কী লেখা হবে তা নিয়ে বাগ্বিতণ্ডা ও ডিসেন্ট। দ্বিতীয়ত, সনদ কীভাবে গৃহীত হবে তা নিয়ে মত-মতান্তর। তৃতীয়ত, সনদে কে স্বাক্ষর দেবেন কিংবা কে স্বাক্ষর দেবেন না, তা নিয়ে টালবাহানা। ইউনুস সরকারের এক বছর সময়কালে অধ্যায় তিনটি দারুণ উপভোগ্য ছিল। আজ যিনি পক্ষে, কাল চলে গেলেন বিপক্ষে; আবার তাঁকে বুঝিয়ে নিমরাজি করানো হলো।
বিএনপি নেতারা বলেছিলেন, সনদ করবে জনগণের পার্লামেন্ট, এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার সনদ করার কে? তাঁরা লাল কালিতে নিজেদের আপত্তি জানিয়ে কালো কালিতে স্বাক্ষর দিয়ে দিয়েছেন। ইসলামি দলগুলি প্রথম প্রথম বেঁকে বসেছিল- তারাও স্বাক্ষর দিয়ে দিয়েছেন। তি এখন শুধু এনসিপিকে নিয়ে ঝামেলা। তারা একদম কলমে তালা দিয়ে রেখেছে। তবে তাদের স্বাক্ষরের জন্য সনদের পাতায় জায়গা রেখে দেওয়া হয়েছে, যে কোনো সময় তারা স্বাক্ষর করে দিয়ে দিতে পারে। রাজনীতিবিদেরা সনদ নিজে নিজ আয়ত্তে রাখতে গিয়ে সেটিকে বেশ রুগ্ন করে ফেলেছেন। কমিশনের ৮৪ টি সংস্কার প্রস্তাব এসেছে, যার কোনটি কী উপকারে আসবে তা বোঝা মুশকিল।
জানা যায়, সনদের ১৬ তম ধারা হলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। শেখ হাসিনার সময়, ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে আপিল বিভাগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করতে আদেশ দিয়েছিলো। আওয়ামী লীগ সরকার ২০১১ সালের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী আইন পাস করে যাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করা হয়। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ পঞ্চদশ সংশোধনীকে আংশিক বাতিল করে। যে অংশটি বাতিল করা হয়েছে, তার ফলে দেশের সংবিধানে আবারও নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা (ত্রয়োদশ সংশোধনী) ফিরে আসার পথ তৈরি হয়েছে, কিন্তু ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের বিরুদ্ধে যে রিভিউ পিটিশন আছে, সেটিরও মীমাংসা হতে হবে। রিভিউ পিটিশনটি আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায় আছে। রিভিউ আবেদন যিনি করেছিলেন তিনি এখন ঐকমত্য কমিশনের একজন সদস্য। রিভিউ আদেশে আপিল বিভাগের সিদ্ধান্ত আবেদনকারীর পক্ষে গেলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল হবে।
সংবিধান সংস্কার কমিশন যেভাবে নিরপেক্ষ সরকার নিয়োগ প্রণালী রচনা করেছে, তাতে বলা যায় রাজনীতিকেরাই নির্ধারণ করবেন কে নিরপেক্ষ সরকারে আসবেন। এতে আরও বলা হয়েছে, কমিটি নিবন্ধিকৃত রাজনৈতিক দলগুলো, সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দলগুলো এবং জাতীয় সংসদের স্বতন্ত্র সদস্যদের কাছ থেকে
সংবিধানের ৫৮ গ অনুচ্ছেদে বর্ণিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা
হওয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তির নাম প্রস্তাবের আহ্বান করবে।এই
বিষয়গুলি বাংলাদেশের আমজনতার অনুধাবনের বাইরে। তারা কেউ এই সব নিয়ে মাথা কূটতে চা না। তারা শুনেছেন, জেনেছেন যে এনসিপি অর্থাৎ, ছাত্র বিপ্লবীদের দল এই সনদে সই করেনি। অথচ বলা হচ্ছে, যে সনদ কদিন আগে স্বাক্ষরিত হল সেই সনদের নির্দেশিকা বা রূপরেখাতেই চলবে দেশের পরবর্তী সরকারগুলি। মানুষএ নিয়েও কোনও মাথা ব্যথা করতে চান না। তারা চান একটা সরকার হোক। সেই সরকার হোক মানুষের ভোটে। মানুষ অনেক বছর সুষ্ঠু স্বাভাবিক নির্বাচন দেখেননি। বিষয়টি প্রজন্মান্তরে যাতে এই ভাবে চলতে না থাকে, অর্থাৎ মানুষের ভোটাধিকার যেন মানুষ নিজে প্রয়োগ করতে পারেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সব দেশেই এই আকাঙক্ষা রয়েছে।বাংলাদেশের মানুষেরও থাকাটা স্বাভাবিক। তারা আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে ভোট করতে চান না, জাতীয় পাটিকেও চান প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। তাদের বহুদলীয় আকাঙ্ক্ষা আদৌ কি পূরণ করতে পারবে কোনও সনদ বা সনদ নির্দেশিত নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার?