দুই চাণক্যের ছক।।
বিহার-ভারতের রাজনীতির বারোমাসি পরীক্ষাগার।আবারও সেই রাজ্যই তৈরি হচ্ছে এক অগ্নিপরীক্ষার জন্য, যেখানে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছেন দুই ‘চাণক্য’, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং ভোটকুশলী প্রশান্ত কিশোর। এই লড়াই কেবল আসনসংখ্যার নয়, বরং ভারতের ভবিষ্যৎ রাজনীতির মানচিত্র নির্ধারণের খেলা।
অমিত শাহের পরিকল্পনায় বিজেপি আজ বিহারের মাঠে এমনভাবে খুঁটি সাজিয়েছে, যাতে খেলায় নামার আগেই তারা অন্তত পাঁচ গোলে এগিয়ে থাকে। এসআইআর প্রক্রিয়ার নামে ভোটার তালিকায় ৪৭ লক্ষ নাম বাদ এবং ৫ লক্ষ ডুপ্লিকেট ভোটারের উপস্থিতি যে কোনো নির্বাচনকেই সন্দেহের ছায়ায় ফেলে দেয়। ২০২০ সালের নির্বাচনে বিজেপি-জেডিইউ জোট মাত্র ০.৩ শতাংশ ভোটের ব্যবধানে ক্ষমতায় এসেছিল। সেই প্রেক্ষাপটে বোঝাই যায়, ভোটার তালিকার এই কারচুপি আসলে কতটা রাজনৈতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ।
অন্যদিকে প্রশান্ত কিশোর যিনি একসময় মোদি-বিজেপির ভোটকৌশল নির্মাতা, আজ সেই প্রভুর বিরুদ্ধেই নিজের স্বদেশ বিহারে নতুন খেলা শুরু করেছেন।তার জন সুরাজ অভিযান কেবল একটি প্রচার নয়, এটি এক পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক আন্দোলনের রূপরেখা, যার লক্ষ্য কেবল তেজস্বী বা নীতীশ নয়- বরং ভোটারদের মানসিকতা বদলে দেওয়া। পিকে জানেন, বিহারের রাজনীতি জাতপাত, ধর্ম ও দলবাজির চৌহদ্দি ছাড়িয়ে নতুন ধারার অপেক্ষায় আছে। সেই আকাঙক্ষাকেই তিনি অস্ত্র করেছেন। খোদ লালু যাদব, তেজস্বী যাদবের দুর্গ বলে পরিচিত রাঘোপুরের মাটিতে দাঁড়িয়ে তার বক্তব্য, ‘ভুল মানুষকে রাজা বানিয়ে আপনি গরিবই থেকে গেছেন’- এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করে দিয়েছে। রাঘোপুরে দাঁড়িয়ে যাদব পরিবারের বিরুদ্ধে কথা বলতে এর আগে বিজেপিও কখনো সাহস দেখাতে পারেনি।
বিহারের রাজনীতিতে জাতপাতের সমীকরণ গুরুত্বপূর্ণ হলেও এবার ভোটার তালিকার কারসাজি ও পিকে-র ‘নয়া বিহার’ স্লোগান লড়াইকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। এনডিএতে বিজেপি, জেডিইউ, চিরাগ পাসোয়ান, জিতেন রাম মাঁঝি ও উপেন্দ্র কুশওয়াহা একত্রিত। তবে বিজেপির কৌশলে নীতীশকে কোণঠাসা করার ছক স্পষ্ট। অন্যদিকে, আরজেডি ও কংগ্রেসের জোটে আসন রফা এখনও অধরা। এছাড়া ওবেইসি, মায়াবতী ও আপ-এর প্রার্থীরা মূলত কংগ্রেসের ভোট কাটতে পারে, যা বিজেপির জন্য সুবিধাজনক।
২০১৪ -এ মোদির জয়ের নেপথ্য কারিগর ছিলেন পি কে, যিনি লালু পরিবারের দুর্গে দাঁড়িয়ে তেজস্বীকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ছেন। তার জন সুরাজ পার্টি কি কংগ্রেসকে ছাপিয়ে যাবে, যেমন কেজরিওয়াল দিল্লীতে করেছিলেন? বিহারের ভোটারদের হাতে এখন ক্ষমতার তলোয়ার। এই মহাযুদ্ধে তারা কি বিষাক্ত চক্রব্যূহ ভাঙবে, নাকি নীরবে হার মানবে? নীতীশ কুমারের দল এবার সমান সমান আসনে বিজেপির সঙ্গে লড়ছে- যা ইঙ্গিত দিচ্ছে, ক্ষমতায় ফিরলেও মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসবে বিজেপিরই কেউ। নীতীশের রাজনৈতিক পরিণতি এখন সময়ের অপেক্ষা মাত্র। বিজেপির লক্ষ্য স্পষ্ট জেডিইউ-কে শেষ করে বিহারে একক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। তারই প্রস্তুতি চলছে অমিত শাহের টেবিল থেকে। অন্যদিকে বিরোধী শিবিরেও ভাঙন। আরজেডি ও কংগ্রেস এখনও আসন সমঝোতায় পৌঁছতে পারেনি। উপরন্তু ‘ল্যান্ড ফর জবস’ মামলায় লালু পরিবারের বিরুদ্ধে চার্জ গঠনের ফলে আরজেডির উপরও দুর্নীতির কালো ছায়া ঘনিয়েছে। এই সব রাজনৈতিক ব্যর্থতা মিলে বিজেপিকে দিয়েছে এক প্রকার ‘ফ্রি পাস’।
এই প্রেক্ষাপটে প্রশান্ত কিশোর হয়ে উঠেছেন বিহারের ভোটযুদ্ধের একমাত্র ‘ওয়াইল্ড কার্ড’। তিনি জানেন, বিহারের রাজনীতি এখন মুখ বনাম মুখের প্রতিযোগিতা – জোটের নয়, নেতৃত্বের। পিকে-র অবস্থান অনেকটা সেই জায়গায়, যেখানে একসময় দিল্লীতে ছিলেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল-নতুন মুখ, নতুন ভঙ্গি, পুরনো রাজনীতির বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভের প্রতীক। বিজেপি জানে, পিকে কংগ্রেসবিরোধী ভোটও কেটে দেবে, তাই আপাত বিরোধিতা সত্ত্বেও তার উত্থান তাদের ক্ষতি করছে না।
বিহারের এই নির্বাচনে তাই তিনটি ধারা সমান্তরালভাবে চলছে- ক্ষমতা ধরে রাখার বিজেপির যান্ত্রিক কৌশল, টিকে থাকার লড়াইয়ে আর জেডি-কংগ্রেসের ক্লান্ত চেষ্টা, আর পরিবর্তনের বার্তা নিয়ে পিকে-র জন আন্দোলন।তিনের সংঘর্ষেই নির্ধারিত হবে বিহারের আগামী দশকের রাজনীতি।
আজ প্রশ্ন একটাই- মহাত্মা গান্ধীর সত্যাগ্রহ আর জয়প্রকাশ নায়ারণের জন্য আন্দোলনের সেই মাটি কি আবার বিদ্রোহের শিখা জ্বালাবে, নাকি ক্ষমতার রাজনীতি সেখানে শুধু নতুন পোশাক পরবে? বিহারের ভোটাররা এবার ঠিক করবেন, তারা পুরনো চাণক্যের কূটচালেই বিশ্বাস রাখবেন, নাকি নতুন চাণক্যের হাতে তুলে দেবেন পরিবর্তনের মশাল।