October 20, 2025

সত্য উচ্চারণের সাহস

 সত্য উচ্চারণের সাহস

অবশেষে স্বপ্নভঙ্গ হলো ডোনাল্ড ট্রাম্পের। যতই আত্মপ্রচার করুন, অযতই আমি নোবেলনা পেলে কে পাবে? বলে চিৎকার করুন না কেন- নোবেল কমিটি তার দিকে ফিরেও তাকাল না। বরং শান্তির প্রতীক হিসেবে বেছে নিলেন এমন এক নারীকে, যিনি ভয়, দমন আর স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সংগ্রাম করছেন। ২০২৫ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার ঘোষণা করেছে নরওয়ে, কমিটি এবং সেটি পেয়েছেন ভেনেজুয়েলার বিরোধী নেত্রী মারিয়া কোরিনা মাচাদো।
এই ঘোষণায় যেন এক লহমায় ভেঙে গেল ট্রাম্পের অহংকারের দুর্গ।
মার্কিন প্রেসিডেন্টের আত্মবিশ্বাস ছিল প্রবল- তিনি নাকি ‘আটটি বড় যুদ্ধ থামিয়ে দিয়েছেন।’ কিন্তু নরওয়ের নোবেল কমিটি দেখিয়ে দিল, শান্তি মানে শুধু গুলী থামানো নয়, শান্তি মানে মানবতা, সহযোগিতা, এবং নৈতিক সাহস। এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে নোবেল কমিটি এ বার্তাও দিল, শান্তি বিক্রি হয় না। শান্তি ক্রয় করা যায় না। শান্তি অর্জন করতে হয়। ‘নরওয়ের নোবেল কমিটির চেয়ারম্যান ইয়োরগেন ওয়াতনে ফ্রিডনেস স্পষ্টভাষায় বলেছেন, ‘আমরা কোনো রাজনীতিকের প্রচারণা নয়, তার কাজের প্রকৃত প্রভাব দেখি। শান্তির জন্য যিনি বাস্তব অবদান রাখেন তিনিই প্রাপ্য।’ এই এক বাক্যেই যেন থেমে গেল ট্রাম্পের সব আত্মপ্রচার। ট্রাম্পের নিজের দাবি ছিল বড়সড়-‘আমি আটটা যুদ্ধ থামিয়েছি, আমি নোবেল না পেলে কে পাবে?
তবে বাস্তব চিত্র একেবারেই উল্টো। সুইডেনের উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২৪ সালে বিশ্বজুড়ে সশস্ত্র সংঘাতের সংখ্যা ছিল রেকর্ড পরিমাণে বেশি। অর্থাৎ, ট্রাম্পের কথিত শান্তি মিশন কাগজে যেমন উচ্চকণ্ঠ, বাস্তবে তার ছায়াও নেই। অসলো পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের প্রধান নিনা গ্রেগার স্পষ্ট ভাষায় বলেন, ‘গাজায় শান্তি আনার চেষ্টা ট্রাম্পের নামেই প্রচার হয়েছিল, কিন্তু ট্রাম্পের একাধিক নীতি নোবেলের মূল দর্শনের পরিপন্থী। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, জাতির সাথে জাতির ভ্রাতৃত্ব, নিরস্ত্রীকরণ-এই তিন মূল্যবোধের সঙ্গে ট্রাম্পের রাজনীতি সম্পূর্ণ বেমানান। তিনি আরও যোগ করেন, ‘আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে সরে যাওয়া, বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করা, গ্রিনল্যান্ড দখলের হুমকি, দেশে ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দমন- এই সব নীতি ট্রাম্পকে নোবেলের দৌড় থেকেও আরও দূরে ঠেলে দিয়েছে। যে পুরস্কার ট্রাম্পের হাতে যাওয়ার আশা ছিল, তা এখন মারিয়া কোরিনা মাচাদোর ঝুলিতে। ভেনেজুয়েলার এই বিরোধী নেত্রী বছরের পর বছর ধরে স্বৈরশাসক নিকোলাস মাদুরোর দমননীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যাচেছন। মাচাদোকে গ্রেপ্তার, হয়রানি, এমনকী রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞায় জর্জরিত করা হয়েছে। তবু তিনি থামেননি। নোবেল কমিটি এবছর স্পষ্টভাবে বার্তা দিয়েছে- শান্তি মানে বন্দুক নামানো নয়, সত্য উচ্চারণের সাহস।
নোবেল না পাওয়া ট্রাম্পের এই পরাজয় শুধু ব্যক্তিগত নয়। ট্রাম্পের এই ব্যর্থতা এক রাজনৈতিক প্রতীকও বটে। কারণ, এটি বোঝাল- বিশ্ব আর ট্রাম্পীয় প্রচারণার মোহে বিভ্রান্ত নয়। নোবেল কমিটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষমতাধর মুখগুলিকে নয়, নীরব সংগ্রামী মানুষগুলিকেই বেছে নিচ্ছে।
নরওয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক হালভার্ড লেইরা বলেন, ‘নোবেল কমিটি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ক্ল্যাসিক ‘শান্তি’ ধারনায় ফিরে এসেছে। মানবাধিকার, গণতন্ত্র, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও নারী অধিকারে তাদের জোর স্পষ্ট। ট্রাম্পের জন্য এই ফলাফল এক বড় শিক্ষা। বিশ্বজুড়ে রাজনীতির মঞ্চে আত্মপ্রচারের জোয়ার যতই প্রবল হোক না কেন, নোবেল কমিটি এখনও এক নৈতিক চেতনায় বিশ্বাসী। তাদের কাছে শান্তি বিক্রির, জিনিস নয়- মারিয়া কোরিনা মাচাদোকে নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত করে এই বার্তাই দিতে চাইল আন্তর্জাতিক নোবেল কমিটি।
এ বছর ৩৩৮ ব্যক্তি ও সংস্থা এই পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিল-যার মধ্যে ছিলেন রুশ বিরোধী নেতা নাভালনির স্ত্রী ইউলিয়া নাভালনায়া, সুদানের যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে কাজ করা সংগঠন ‘ইমার্জেন্সি রেসপন্স রুমস’ এবং ইউরোপের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থা ODIHR। তবু কমিটি বেছে নিয়েছে এক প্রতিরোধের প্রতীককে। ডোনাল্ড ট্রাম্প চেয়েছিলেন ইতিহাসে নিজের নাম লেখাতে শান্তির দূত হিসেবে।
কিন্তু ইতিহাস সবসময় সবাইকে ‘শান্তির নায়ক’ হিসেবে নয়, কখনও কখনও কাউকে ‘শান্তির প্রতারণাকারী’ হিসেবেও মনে রাখে। নোবেল কমিটি আজ সেটিই মনে করিয়ে দিল- ‘শান্তি জেতার বস্তু নয়, সেটা অর্জনের নাম।’ এই সিদ্ধান্তে বিশ্ব দেখল এক স্পষ্ট বার্তা- অহংকার নয়, মানবতা-ই শেষ পর্যন্ত জেতে। এই পরাজয় কেবল ট্রাম্পের ব্যক্তিগত নয়- এটি এক রাজনৈতিক দর্শনের পতন। একটি যুগ, যেখানে ক্ষমতাবানরা শান্তির সংজ্ঞাকেও নিজেদের ইচ্ছেমতো বদলাতে চেয়েছিল, সেখানে নোবেল কমিটি দাঁড় করাল এক কঠিন প্রতিবাদ। শান্তি বিক্রি হয় না, শান্তি কেনা যায় না-শান্তি অর্জন করতে হয়। ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই নোবেল ব্যর্থতা ইতিহাসে এক প্রতীক হয়ে থাকবে, যেখানে ক্ষমতার দাম কমে যায়, আর নৈতিকতার দাম বেড়ে যায়। নোবেল কমিটি এবার প্রমাণ করেছে, তারা রাজনীতির দাস নয়, বিবেকের কন্ঠস্বর। তারা দেখাল, শান্তি পুরস্কার কোনো গলা ফাটানো নেতার জন্য নয় এবং সেই সব নীরব সংগ্রামীদের জন্য-যারা মানবতার জন্য লড়েন, ক্ষমতার জন্য নয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *