শীতল আগুন

জম্মু-কাশ্মীরের বিভাজনের পর পাঁচ বছর অতিক্রান্ত। অথচ তিনটি জড়বীরের ৩ ভূখণ্ডই আজ অশান্ত। কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলা, জম্মুতে ক্রমবর্ধমান জঙ্গি-আতঙ্ক ও জনরোষ, সব মিলিয়ে কেন্দ্রের ‘স্বাভাবিকতা ফিরেছে’ গল্প ভেঙে পড়েছে বারংবার। পাক সীমান্ত ছেড়ে এবার অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়েছে লাদাখে। যার অদূরে চিন! সেখানে ভঙ্গুর শান্তি ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলীতে চারজনের মৃত্যু ও আশি জনেরও বেশি আহত হওয়ার ঘটনা। কেন্দ্রীয় সরকার মনে করে, এই সংঘর্ষের কেন্দ্রে রয়েছেন এক ব্যক্তি ইঞ্জিনীয়ার, গবেষক ও সমাজকর্মী সোনম ওয়াংচুক, যার নাম জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের চরিত্রে অমর হলেও বাস্তবের ভূমিকাই আজ রাজনৈতিক বিস্ফোরণ ডেকে এনেছে।
ওয়াংচুক দীর্ঘদিন যাবৎ সংবেদনশীল স্থানীয় ইস্যুগুলি তুলে ধরে এসেছেন। বিশেষত লাদাখবাসীর অন্যতম দুই দাবি রাজ্যের মর্যাদা ও ষষ্ঠ তফশিলের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে সত্যাগ্রহের পথে আন্দোলন চালাচ্ছেন। সোনমের কণ্ঠস্বর কালক্রমে লাদাখের মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে উঠেছে। কিন্তু এর প্রতিক্রিয়ায় রাষ্ট্র বেছে নিয়েছে দমননীতি। রাষ্ট্র শুধু কারফিউ জারি করে ও বিদেশি অনুদান নিয়ন্ত্রণ আইন (এফসিআরএ) লঙ্ঘনের অভিযোগে তার এনজিওর লাইসেন্স বাতিল করেই ক্ষান্ত হয়নি, লাদাখের প্রাণহানি ও অশান্তির ঘটনায় তিন দিনের মাথায় শুক্রবার তাকে রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার মতো স্পর্শকাতর অভিযোগ এনে জাতীয় নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করেছে। এটি কেবল এক ব্যক্তিকে লক্ষ্য করা নয়, গোটা জনগোষ্ঠীর উদ্বেগকে অস্বীকার করা। লাদাখবাসীর মূল তিনটি দাবি সরল; রাজ্যের মর্যাদা, ষষ্ঠ তফশিলের সুরক্ষা এবং পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার নিশ্চয়তা। অথচ সরকার সমস্যার মূলে হাত না দিয়ে দুর্ভাগ্যজনকভাবে দমননীতিকে বেছে নিয়েছে। ওয়াংচুক সহিংসতার প্রতিবাদে অনশন ভেঙেছিলেন, অথচ তাকেই ‘অপরাধী’ বানানো হচ্ছে। এর মাধ্যমে সম্ভবত রাষ্ট্র এই বার্তা ছড়িয়ে দিতে চেয়েছে যে, বিরোধী কণ্ঠকে নীরব করা গেলে যাবতীয় সমস্যার নিরসন হয়। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে তা কি হয়! প্রশ্নটা এখানেই; একজন পরিবেশকর্মী ও শিক্ষাবিদকে ‘জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি’ হিসেবে দেখা আসলে জনমতের প্রশ্ন থেকে দৃষ্টি সরানোর কৌশল ছাড়া আর কিছু নয়।

সোনম ওয়াংচুকের গ্রেপ্তার এবং তার আগে ঘটে যাওয়া সহিংসতা এক ভয়াবহ সংকেত বহন করছে। রাষ্ট্র যদি বারবার বিরোধী কণ্ঠকে অপরাধী সাজায়, তবে গণতন্ত্রের ভিত দুর্বল হয়। ওয়াংচুকের অবস্থান বরং ছিল সহিংসতার প্রতিবাদে অনশন ভাঙা, অর্থাৎ শান্তির বার্তা। অথচ তার ভূমিকাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করা হল, চাপানো হল যূপকাষ্ঠে। এতে স্পষ্ট; সরকার সমস্যার মূলে হাত না দিয়ে প্রতীকী ব্যক্তিকে ‘বলির পাঁঠা’ বানাতে চাইছে। প্রশ্ন হচ্ছে, ২০১৯ সালে জম্মু-কাশ্মীর ভাঙার সময় লাদাখকে কেন আইনসভা-বিহীন কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ফেলে দেওয়া হয়েছিল? কেন এত বছর পরেও লাদাখবাসীর আত্মপরিচয় ও রাজনৈতিক সুরক্ষার দাবি অনুত্তরিত রয়ে গেছে? এই শূন্যতাই আজ অস্থিরতা, অবিশ্বাস ও উত্তেজনার জন্ম দিয়েছে। সময়ক্ষেপণ যে কতটা ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনে, তার নমুনা আমরা মণিপুরে প্রত্যক্ষ করেছি। লাদাখের ক্ষেত্রেও যদি একই পথ অনুসৃত হয়, তবে তা শুধু আঞ্চলিক নয়, জাতীয় নিরাপত্তার জন্যও সমূহ বিপদ ডেকে আনবে।
আসন্ন হিল ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিল নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কেন্দ্রীয় সরকার যদি কেবল ভোটের অঙ্ক কষে, তবে তা জনআকাঙ্ক্ষাকে আরও উপেক্ষা করার নামান্তর হবে। কিন্তু মানুষের দাবি রাজনীতির কূটচাল নয়, বাস্তব জীবনের প্রয়োজন। রাজনৈতিক অধিকার, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও পরিবেশগত সুরক্ষা- এই তিন ক্ষেত্রেই আজ লাদাখবাসীর নির্ভরযোগ্য উত্তর প্রয়োজন। গণতন্ত্রের শক্তি দমন নয়, আলোচনা ও প্রতিনিধিত্ব। সোনম ওয়াংচুকের কণ্ঠকে নীরব করার চেষ্টা মূল সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলবে। ভারতের জন্য লাদাখ শুধু সীমান্ত নয়; এটি কৌশলগতভাবে স্পর্শকাতর অঞ্চল। সেখানে জনগণের আস্থা হারানো মানে গোটা রাষ্ট্রকেই অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দেওয়া।
সরকারের সামনে বিকল্প পথ স্পষ্ট, বিলম্বের কৌশল ত্যাগ করে দ্রুত, স্বচ্ছ ও প্রতিনিধিত্বশীল সমাধান খুঁজতে হবে। মানুষের কণ্ঠস্বরকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আত্মবিশ্বাসের পরিপন্থী। লাদাখে আজ যে আগুন জ্বলছে, সেটিকে আরও প্রজ্বলিত করা নয়, বরং নির্বাপণের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। গণতন্ত্রের পথ পরিষ্কার; মানুষের দাবি শোনো, সমাধানের পথ খোঁজো, আর আস্থা পুনরুদ্ধার করো। শীতল আগুনে লাদাখকে পুড়িয়ে ফেলার আগে রাষ্ট্রকে সেই সত্য উপলব্ধি করতেই হবে।