September 15, 2025

নেই নিরাময় বার্তা!!

 নেই নিরাময় বার্তা!!

আড়াই বছর ধরে হিংসার আগুনে ছারখার হয়ে গেছে ছোট্ট রাজ্য মণিপুর। ২০২৩ সালের ৩ মে থেকে শুরু হওয়া সংঘর্ষ এখনও থামাতে পারেনি প্রশাসন। মণিপুরে কুকি-মেইতেই জাতি সংঘর্ষে ৩০০’র বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। ৬৫ হাজার মানুষ ঘরছাড়া। আহত হয়েছেন অন্তত হাজার দুয়েক মানুষ। সরকারী ও বেসরকারী সম্পত্তি বিনষ্টের খতিয়ান দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর। তবুও ভয়ঙ্কর জাতি সংঘর্ষের দিনগুলোতে, একবারের জন্যও প্রধানমন্ত্রীর সময় হয়নি বিপন্নদের পাশে দাঁড়ানোর।
অবশেষে আড়াই বছর পর জটিল ও সংবেদনশীল মণিপুরে তিনি পা রাখলেন। এর আগে দেশের বিরোধী দলগুলো প্রধানমন্ত্রীকে বারবার অনুরোধ রেখেছিলেন সর্বদলীয় প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিয়ে মণিপুরে চলুন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু বিরোধীদের প্রস্তাবে সাড়া দেননি তিনি। বিরোধীরা অভিযোগ করেছেন, এই সময়ের মধ্যে অন্তত ৪৬ বার বিদেশ সফর করেছেন প্রধানমন্ত্রী। অথচ মণিপুরে যাওয়ার সময় করে উঠতে পারেন নি তিনি। অবশেষে সময় হয়েছে মণিপুর সফরের। আড়াই বছর পর মাত্র ৩ ঘন্টার জন্য মণিপুর সফর করেছেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সফর অনেক সত্যকে চোখে আঙুল তুলে দেখিয়ে দিয়েছে। মণিপুর সফরে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী মণিপুরে অশান্তির পেছনে এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় সমস্যার জন্য বিরোধীদেরকেই দায়ী করে এসেছেন। কিন্তু যে সত্যকে তিনি আড়াল করতে পারেননি তা হলো, পরিস্থিতির গভীরতা। রাজ্যে বিভাজনের ক্ষত কতটা গভীর, সেটা বুঝিয়ে দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর সফরসূচি। কেননা তিন ঘন্টার সফরে মোদিকে আলাদা আলাদা করে ২ টি সভা করতে হয়েছে। একটি ছিল কুকি প্রধান চূড়াচাঁদ পুরে, আর দ্বিতীয়টি ছিল মেইতেই অধ্যুষিত ইম্ফলে। শুধু তাই নয়, শনিবার প্রধানমন্ত্রী কয়েক মুহূর্তের জন্য মণিপুরে আসছেন, সেই কথাটাও ঘোষণা করতে হয়েছে সফরের ঠিক আগের দিন শুক্রবার। মাত্র তিন ঘন্টার সফরে মোদির সভায় যাদের আমন্ত্রণ করা হয়েছে, তাদের জন্যও ছিল একগাদা নীতি নির্দেশিকা। মোবাইল, ক্যামেরা নিয়ে ঢোকা যাবে না সভায়। মোদির সভায় ফটোগ্রাফি ছিল নিষিদ্ধ। এককথায় প্রধানমন্ত্রীর সভায় আমন্ত্রিত ও অংশগ্রহণকারীদের মাঠে ঢুকতে হবে খালি হাতেই। সুতরাং জাতি সংঘাত বিধ্বস্ত মণিপুরে আড়াই বছর বাদে প্রধানমন্ত্রী তিন ঘন্টার সফরে এলেও পরিস্থিতির গভীরতা এবং ক্ষতটা যে কতটা দগদগে এই নীতি নির্দেশিকা, সফরের সূচি থেকেই তার আঁচ পাওয়া যায়। ঘটনা হলো ২০২২ সালে মার্চ মাসে ভোট হয়েছিল মণিপুরে। ভোটের প্রচারে সর্বশেষ মণিপুরে এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী ফেব্রুয়ারীতে। নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজেপি ক্ষমতায় আসার ১ বছরের মধ্যেই জাতিসংঘাতে ক্ষত-বিক্ষত দগ্ধ হয়ে পড়ে মণিপুর। সেই থেকে মোদি আর মণিপুরমুখো হননি। এই ঘটনাক্রমে থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট যে, মণিপুরে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার নিজেদের সাংবিধানিক দায়িত্ব যেমন পালন করেনি, তেমনি কেন্দ্রীয় সরকার মণিপুরের পরিস্থিতি নিয়ে সংসদে বিতর্কের প্রস্তাবও খারিজ করে দিয়েছিল।আর পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করে নিজেদের আড়াল করার চেষ্টা করেছিল ক্ষমতাসীনরা। যে কারণে মণিপুরে জাতি সংঘাতের পেছনে শাসকের বিভাজনের রাজনীতি ও প্রচারকে চিহ্নিত করেছেন রাজ্যের প্রায় সকল অংশের মানুষ। সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন পেতে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে প্রচার হয়েছে। খোদ মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে সংখ্যালঘুদের বহিরাগত বলার অভিযোগ উঠেছে। এমনকী জাতি-সংঘাতের সময় প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়েও বারবার প্রশ্ন উঠেছে। যদিও দুই জনসভাতেই মোদি পরবর্তী প্রজন্মের জন্য দীর্ঘস্থায়ী শান্তির কথা বলেছেন। ৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকার প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক শিলান্যাসও করেছেন। জাতীয় সড়কের জন্য ৩৭০০ কোটির কাজ ইতিমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে এবং আরও ৮৭০০ কোটি টাকার জাতীয় সড়কের কাজ সম্পন্ন করার কথাও বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। ঘটনা হলো, আর্থিক প্যাকেজ আর উন্নয়নের ঘোষণা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী পরিস্থিতিকে সামাল দেওয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা হয়তো করার প্রয়াস নিয়েছেন। কিন্তু দলের প্রাদেশিক রাজনীতি ও বিভাজনের কালিমা মণিপুরে প্রধান দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে যে দগদগে ক্ষত তৈরি করেছে তাকে কি শুধুই আর্থিক প্যাকেজ দিয়ে শোধরানো সম্ভব! মনে রাখতে হবে শিলান্যাস আর উদ্বোধন দিয়ে হৃদয়ের ক্ষতকে দূর করা যায়য় না। এর জন্য চাই হৃদয়ের উদ্যানে ভালোবাসার স্পর্শ। রাষ্ট্রপতি শাসিত মণিপুরে প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে রাষ্ট্রপতি শাসনের অবসানের কথা যেমন শোনা যায়নি, তেমনি কুকিদের নিয়েও কোনও আশ্বাসবাণী মণিপুর শুনতে পায়নি। ফলে প্রধানমন্ত্রীর সফরে মণিপুরবাসীর মধ্যে বিস্তর প্রত্যাশা সত্ত্বেও সেটা মোদি কতটা পূরণ করতে পেরেছেন সেই প্রশ্ন কিন্তু রয়েই গেল। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের মধ্যে সংকটের গভীরতা যে ফুটে উঠেনি সেটা ইতিমধ্যেই বলাবলি করতে শুরু করেছেন স্থানীয়রা। শুধু বাস্তুচ্যুত পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাত করনেই মণিপুরে ক্ষত বোঝা সম্ভব নয়। এর জন্য অন্তত মণিপুরে একটা রাত্রি যাপন করা প্রয়োজন ছিল। নিদেনপক্ষে ত্রাণ শিবিরে গিয়ে সাক্ষাৎ করলেও মানুষের হৃদয়ের ক্ষতটা উপলব্ধি করা যেত। চটজলদি সফর করে মানুষের মনে আস্থা সৃষ্টি করা যে কঠিন, সেটা প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর হয়তো উপলব্ধি করতে চায়নি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *