August 27, 2025

ইজরায়েলের বন্ধু বিচ্ছেদ!

 ইজরায়েলের বন্ধু বিচ্ছেদ!

টানা দুই বছর ধরে গাজায় নির্বিচার হামলার ঘটনা চলছে। হত্যালীলা মানবতার যেকোনো উদাহরণকে লঙ্ঘন করে চলেছে।একতরফা দুই বছর ধরে হত্যা হামলার ঘটনায় বিশ্ব জনমত নড়েচড়ে বসেছে। নানা দেশে বিশেষত ইউরোপীয় এবং পশ্চিম দুনিয়ায় এর প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। নিরবচ্ছিন্ন না হলেও এর প্রতিক্রিয়া নানা জায়গায় তীব্র আকার নিচ্ছে। জনমতের বড় পরিবর্তন আঁচ করতে পেরেছে অস্ট্রেলিয়া। তারা এবার ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বস্ত মিত্র ইজরায়েল। তাদের এই সিদ্ধান্তে নেতানিয়াহু অসন্তুষ্ট হলেও শঙ্কিত নয় দেশটি। কারণ আভ্যন্তরীণ জনমতের চাপ।
গত ১১ আগষ্ট অস্ট্রেলিয়া সরকার ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানায়।এর মাত্র কয়েকদিন আগে সিডনির হারবার ব্রিজে হাজার হাজার মানুষ গাজায় শান্তি প্রতিষ্ঠা ও ত্রাণ সরবরাহের দাবিতে মিছিল করেন। প্রসঙ্গত, প্রায় দুই বছর আগে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস ইজরায়েলে ঢুকে নজিরবিহীন হামলা চালায়। সেই হামলার প্রতিশোধ নিতে সেদিন থেকেই গাজায় যুদ্ধ শুরু করে ইজরায়েল। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত গাজা উপত্যকায় ৬২ হাজার ১৯২ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে ইজরায়েল। রাষ্ট্রপুঞ্জের নানা সংস্থার রিপোর্ট বলেছে, গাজা নগরীতে দুর্ভিক্ষ চলছে। আবার সেখানে খাদ্য বিলির শিবির বানিয়েছে ইজরায়েল। ক্ষুধার্ত মানুষের লাইনেও চলছে গুলী।
অস্ট্রেলিয়ায় গাজার ওপর এই ধরনের হামলার ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে জনমতে। সেই দেশের বুদ্ধিজীবীরা ইজরায়েলের ভূমিকাকে আর নিতে পারছেন না। সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইজরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত বিশেষজ্ঞ মার্টিন কেয়ার বলেন, সব দোষ হামাসের ঘাড়ে চাপানো এবং ইজরায়েলকে নিঃশর্তে সমর্থন জানানোর বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য হয়ে উঠছে। অস্ট্রেলিয়া ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতির সিদ্ধান্ত ঘোষণায় ইজরায়েল এবার বন্ধুরাষ্ট্র অস্ট্রেলিয়া সম্পর্ক এমন কূটনৈতিক টানাপোড়েনের মুখে পড়েছে, যা কয়েক দশকেও দেখা যায়নি।এ ইস্যুতে দুই দেশের শীর্ষ রাজনীতিকেরা একে অপরকে কটাক্ষ করছেন।ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করেছেন। পশ্চিম তীরে নিযুক্ত অস্ট্রেলিয় কূটনীতিকদের ভিসা বাতিল করেছে ইজরায়েল। অন্যদিকে একজন ইজরায়েলি সংসদ সদস্যকে অস্ট্রেলিয়ায় ঢুকতে দেওয়া হয়নি।
অস্ট্রেলিয়ার ইহুদি জনসংখ্যা কম নয়। সে দেশের একটি ইহুদি সংগঠন বর্তমান পরিস্থিতিতে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছে ইজরায়েলের প্রতি। সংগঠনটি নজিরবিহীনভাবে নেতানিয়াহুর সমালোচনা করেছে। অস্ট্রেলিয়ার অনেক ইহুদি নাগরিক বলছেন, দুটি দেশের মধ্যে কূটনৈতিক এই টানাপোড়েনে তারা মনে মনে নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কা করছেন। কারণ গত এক বছর অস্ট্রেলিয়ায় একাধিক ইহুদিবিদ্বেষী হামলা হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজ আগেই বলেছেন, অস্ট্রেলিয়ায় দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠী মুসলিম। মুসলিম সমাজ ও সংখ্যালঘু ইহুদিদের কাছে গাজা সংঘাত একটি বিতর্কিত বিষয়। দেশটিতে জনমত সমীক্ষায় দেখা গেছে, এ সংঘাতে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সেখানকার মানুষের সহানুভূতি দিনে দিনে বাড়ছে। এই আগষ্টে অস্ট্রেলিয়ার এক সমীক্ষায় দেখানো হয়, ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার পক্ষে সমর্থন জানিয়েছেন ৪৫ শতাংশ মানুষ। গত বছর এই সংখ্যাটি ছিল ৩৫ শতাংশ। স্বীকৃতির বিরোধিতা করছেন ২৩ শতাংশ মানুষ।
অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজ দীর্ঘদিন ব্যক্তিগতভাবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে সমর্থন করলেও রাজনৈতিক রাষ্ট্রকে বাস্তবতায় সরকারীভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে এতদিন সতর্ক ছিলেন।জনমতের পরিবর্তনে তার এ অবস্থানেরও বদল হয়েছে।গত মে মাসের নির্বাচনে বিশাল জয় পাওয়ার পর ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্তে জনগণের তোপে পড়ার ঝুঁকিও কমে গেছে। বরং জনমত সমীক্ষার রিপোর্ট তার সঙ্গেই রয়েছে। বলা হচ্ছে গাজায় দুর্ভিক্ষের ভয়ঙ্কর চিত্র সামনে আসার পর ইজরায়েলের প্রতি অস্ট্রেলিয়ার জনগণের সহানুভূতি দ্রুত কমতে শুরু করেছে। ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে গাজার ছবিগুলো অস্ট্রেলিয়ার সংসদে আইন প্রণেতাদের শক্তি জুগিয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার বুদ্ধিজীবী মহল মনে করেন, এই দেশের নীতিনির্ধারকদের মানসিকতার যে বদল ঘটেছে তেমনটা অন্যান্য দেশেও হয়েছে ও হচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ায় দুই শতাধিক ইহুদি গোষ্ঠীর মাতৃ সংগঠন হিসাবে কাজ করে এগজিকিউটিভ কাউন্সিল অব্ অস্ট্রেলিয়ান জিউরি। অস্ট্রেলিয়া ও ইজরায়েলের মধ্যকার রাজনৈতিক টানাপোড়েনে সংগঠনটি উদ্বেগ প্রকাশ করে আলবানিজ ও নেতানিয়াহুকে চিঠি লিখে উত্তেজনা কমানোর আহ্বান জানিয়েছে।
চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘যদি জনসমক্ষে কোনো কিছু বলতে হয়, তবে তা যেন একজন জাতীয় নেতার জন্য মানানসই, সংযত ও মর্যাদাপূর্ণ ভাষায় বলা হয়।’ ব্রিটেন, ফ্রান্স ও কানাডা ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণা দেওয়ায় এই দফায় অস্ট্রেলিয়ার জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হয়েছে। প্রসঙ্গত, গাজার যুদ্ধ শুরুর পর থেকে অস্ট্রেলিয়ায় ইহুদিদের উপাসনালয়, বাড়ি ও গাড়িতে একাধিক ইহুদিবিদ্বেষী হামলা হয়েছে। অনেক ইহুদি আশঙ্কা করছেন, অস্ট্রেলিয়া-ইজরায়েলের মধ্যে উত্তেজনা বাড়তে থাকলে এমন হামলার ঘটনাও বাড়তে পারে। এরই মধ্যে সরকারি মহলে বলাবলি শুরু হয়েছে, সংবাদমাধ্যমে রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনায় ইজরায়েলের সমালোচনার দিকে এত বেশি মনোযোগ দিলে এর প্রভাব স্থানীয় ইহুদি সম্প্রদায়ের ওপর পড়বে। আমাদের এটা ভেবে দেখা দরকার।
প্রসঙ্গত, অস্ট্রেলিয়া শুরু থেকেই একটি ইহুদি রাষ্ট্রের সমর্থক ছিল।আন্তর্জাতিক নানা বিবাদে লম্বা সময় ধরে ইজরায়েলের পাশে।তবে অস্ট্রেলিয়ার প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো নীতিগতভাবে ইজরায়েল-ফিলিস্তিন সংকটের দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের নীতি সমর্থন করে। অস্ট্রেলিয়ার সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তে প্রমাদ গুনছেন নেতানিয়াহু। দেখা গেছে, ১১ আগস্টের পর থেকে নেতানিয়াহু একাধিক সাক্ষাৎকার ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলবানিজকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করছেন। তিনি আলবানিজকে একজন দুর্বল নেতা বলেছেন ও ইজরায়েলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার অভিযোগও তুলেছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *