বিলম্বিত পদক্ষেপ!!
বহু প্রতীক্ষিত ‘অনলাইন গেমিং প্রচার ও নিয়ন্ত্রণ বিল-২০২৫ বুধবার লোকসভায় পাস হওয়ার পর বৃহস্পতিবার রাজ্যসভায় অনুমোদিত হয়েছে। এই বিলের উদ্দেশ্য, অনলাইন গেমিংয়ের টাকা লেনদেন ও বিজ্ঞাপন পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা। অর্থাৎ অনলাইন গেমিংয়ে এখন থেকে আর টাকার লেনদেন করা যাবে না। যদি কোন গেমিং অ্যাপ এই নিয়ম ভাঙে, তবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া যাবে এই আইন বলে। মোদ্দা কথায় রাষ্ট্রপতির সম্মতি পেয়ে এই বিল আইনে পরিণত হলে যেসব অনলাইন গেমে মানুষ টাকা লাগায় সেগুলো এখন থেকে নিষিদ্ধ হয়ে যাবে।
প্রায়ই আমরা আইপিএল,টি- ২০, ওয়ানডে ক্রিকেট ম্যাচে চলাকালীন টিভিতে বিজ্ঞাপনে দেখি- মাত্র ২ ঘন্টার কোটিপতি হয়ে যান। এই বিজ্ঞাপনগুলোই মানুষকে প্রলোভন দেখায় অনলাইনে টাকা বিনিয়োগ করার জন্য। কোটিপতি হওয়ার স্বপ্নে এভাবেই অনলাইন জুয়ার জড়িয়ে ১৮ থেকে ৮০ বিভিন্ন বয়সের মানুষ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই ফাঁদে সর্বস্ব খুইয়ে মাথা চাপড়ান ৯০ ভাগ মানুষই। বিলে প্রস্তাব করা হয়েছে নিয়ম এই আইন কার্যকর হয়ে গেলে নিয়ম ভেঙে অনলাইন মানি গেমিং সার্ভিস চললে ৩ বছর পর্যন্ত জেল ও জরিমানা দুটোই শাস্তি হিসাবে বলবৎ হবে। গত কয়েক বছর ধরেই দেশে অনলাইন গেমিং শিল্প তরতর করে ফুলেফেঁপে উঠছিল। অনলাইন গেমে বাজি ধরার পেছনে প্রতিমাসে ভারতে গড়ে ১০ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়। ফলে হু হু করে ব্যাঙের ছাতার মতো বাড়তে থাকে এই অনলাইন ব্যবসা। ছোট, বড়, মাঝারি বহু সংস্থা গজিয়েি উঠে এই সময়ে। এবার কেন্দ্রের এই আইনের ফলে সেই সংস্থাগুলো ক্ষতির মুখে পড়বে। বলা হচ্ছে, অনলাইন গেমে বিপুল লেনদেন, প্রতারণা এবং আসক্তি এমনকি অর্থ পাচারের মতো ঘটনা নিয়ন্ত্রনহীনভাবে বেড়ে চলেছিল। দেশের যুব সমাজের একটা বড় অংশ এই ধরনের আর্থিক লেনদেন তথা জুয়ায় জড়িয়ে আর্থিকভাবে সর্বস্বান্ত হয়ে পরেছিলেন। তা থেকে জনগণকে সুরক্ষার লক্ষ্যেই এই পদক্ষেপ।কিন্তু কেন্দ্রের এই পদক্ষেপ নিয়েও জোর বিতর্কের অবকাশ রয়েছে।যদিও বিলে বলা হয়েছে এই আইনে ‘রিয়েল ও মানি গেমিং নিষিদ্ধ হবে। এই গেমের ক্ষেত্রে আর্থিক লেনদেনের কাজ ব্যাঙ্ক এবং অন্যান্য পেমেন্ট গেটওয়ে করতে পারবে না। এই ধরনের অনলাইন গেমের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ থাকবে। পাশাপাশি বিনামূল্যে খেলা যায় অথবা সাবস্ক্রিপশন নিতে হয় এমন গেম চালু থাকবে। কিন্তু টাকা দিয়ে খেলার সুযোগ থাকবে না। কিন্তু পাল্টা যুক্তি হিসাবে এটাও বলা হচ্ছে অনলাইন গেমিংয়ের উপর সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা চাপালে কর্মসংস্থান নষ্ট হবে। তাছাড়া যারা এই খেলায় আসক্ত তারা ঠিকই অন্য কোনো প্ল্যাটফর্মে গিয়ে খেলবেন। এতে করে বেআইনি গেমিং সাইটে গিয়ে খেলার জন্য তাদের ঝুঁকি বাড়বে। আবার অন্যদিকে বর্তমানে ভারতের গেমিং ইন্ডাস্ট্রির বাজারমূল্য রয়েছে ৩.৭ বিলিয়ন ডলার। ২০২৯ সালে মধ্যে এর বাজার মূল্য বেড়ে দাঁড়াবে ৯.১ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এই সেক্টরের বাজারমূল্য বাড়ছে বার্ষিক ১৯.৬ শতাংশ হারে। ফলে এমন আইন কার্যকর হলে একদিকে যেমন ক্ষতির মুখে পড়বে বহু সংস্থা, তেমনি কর্মসংস্থান হারাবেন এই কাজের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ২ লক্ষ মানুষ। আবার ২৫ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ ক্ষতির মুখে পড়লে তা থেকে বার্ষিক ২০ হাজার কোটি টাকার জিএসটি ও আদায় হবে না। আসলে দেশে আর্থিক ঝুঁকিপূর্ণ বিভিন্ন ধরনের অনলাইন গেমগুলির উপর সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে এমন এক সময়ে, যখন সেগুলি ভালোভাবেই দেশের সমাজ ও অর্থনীতির উপর জাঁকিয়ে বসেছিল। অনেক আগেই সরকারকে এই ক্ষেত্রে সুচিন্তিত ও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন ছিল। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হলো এটি এমন এক সংবেদনশীল বিষয় যার সঙ্গে দেশের তরুণ ও যুব প্রজন্মের ভবিষ্যৎ জড়িয়ে পড়েছিল। তাদের মধ্যে এই খেলার প্রতি আসক্তি, আর্থিক ক্ষতি এবং ঋণগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যার প্রবণতা উদ্বেগজনক পর্যায়ে ঠেকেছিল। আবার এর সঙ্গে দেশের আর্থিক সমৃদ্ধি জড়িয়ে রয়েছে। অথচ প্রাথমিক হিসাবে বলা হচ্ছে দেশের প্রায় ৪০ কোটির বেশি মানুষ এই অনলাইন খেলার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। অনলাইন গেমিং ইন্ডাস্ট্রির উদ্বেগের কারণ হল,এখন দেশে এই ইন্ডাস্ট্রির আয়তন ৩৭০ কোটি ডলারের মতো।এই সংস্থাগুলোর সঙ্গে বহু মানুষের কর্মসংস্থানের বিষয়টিও আছে।ইতিপূর্বে এই ধরনের গেম জুয়া কিনা তা নিয়েও বহু প্রশ্ন উঠেছে। মামলাও হয়েছে একাধিক। উচ্চ আদালতের রায় বলেছে যে, স্কিল বেসড গেম জুয়া নয়। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে সাধুবাদ যোগ্য হলেও, সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞার পরিবর্তে নির্দিষ্ট শর্তের ভিত্তিতে ব্যবসার বিকল্প ভাবনার সুযোগ থাকতো কিনা সেটা বিবেচনার মধ্যে আনা যেত বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। ব্রিটেন, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে অনলাইন গেমিং যেমন জনপ্রিয়, তেমনি এর বিস্তর বিধিনিষেধ ও কড়াকড়িও আছে। বিজ্ঞাপন প্রচারেরও নানা নিয়ম আছে। কিন্তু টাকার বিনিময়ে খেলায় গড়াপেটা বিস্তর অভিযোগ দীর্ঘদিনের। আছে যুব সমাজের ভবিষ্যতের দিকটিও।দেশের ৪৫ কোটি মানুষ অনলাইন গেমিংয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন বলে বৃহস্পতিবার রাজ্যসভায় বিল পেশ করে খোদ জানিয়েছেন তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব। সব মিলিয়ে নয়া আইন দেশের যুব সমাজকে সুরক্ষিত করতে কার্যকরী হবে এটাই প্রত্যাশা।