August 14, 2025

আধারে ‘আধার’

 আধারে ‘আধার’

ধারা পাল্টে ফেলেছে মাও সে তুং-এর চিন। তেমনই ধারা পাল্টে ফেলেছে নরেন্দ্র মোদির ভারত।আমূল পাল্টে ফেলেছে। পনেরো বছর আগে যে উদ্যোগটিকে দেশের ভবিষ্যৎ বদলে দেওয়ার চাবিকাঠি বলে ঘোষণা করা হয়েছিল, তার নাম- আধার।বলা হয়েছিল, এক কার্ডে একজন নাগরিকের পরিচয়, ঠিকানা, জন্মতারিখ, বায়োমেট্রিক, সব থাকবে। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলা হোক বা মোবাইলে সিম নেওয়া, রেশন কিংবা সরাসরি সরকারী ভর্তুকি, সব ক্ষেত্রেই আধার হবে সর্বজনগ্রাহ্য প্রমাণপত্র। রাজকোষের বিপুল অর্থ ব্যয় করে, কোটি কোটি মানুষকে বায়োমেট্রিক ক্যাম্পের লাইনে দাঁড় করিয়ে, বস্তুত সাড়ম্বরে আধারকে জাতীয় পরিচয়ের একপ্রকার ‘ডিজিটাল মেরুদণ্ড’ বানানো হয়েছিল। ‘আধার’ নামের প্রকল্প শুরু হয়েছিল এমন এক প্রতিশ্রুতি নিয়ে, যা শুনে বহু মানুষের মনে হয়েছিল, এখান থেকেই প্রারম্ভ হলো ডিজিটাল গণতন্ত্রের মুক্তিযুদ্ধ। আয়তক্ষেত্র বিশিষ্ট ছোট এই কার্ডটি থাকবে মানিব্যাগে, কিন্তু তার ক্ষমতা থাকবে মানচিত্রে – ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট, মোবাইল সিম, রেশন, গ্যাস ভর্তুকি, পেনশন, বৃত্তি সহ নাগরিক পরিচয়ের সমগ্র পরিসরে। কিন্তু সে জমানা আজ আমূল পরিবর্তিত। আধারের সেই রাজসূয় যজ্ঞশালার পনেরো বছর পর আজ, বিহারে নির্বাচন কমিশনের বিশেষ নিবিড় সংশোধনী প্রক্রিয়াতে সেই আধার যেন এক প্রেতাত্মা, সেটির অস্তিত্ব আপেক্ষিক। আধার নাগরিকত্বের ‘যথেষ্ট’ প্রমাণ নয়। বরং তাদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে নতুন হরেক শর্ত পূরণ করতে হবে। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে এই প্রথম ভোটার তালিকায় নাম রাখার মৌলিক অধিকার ভোগ করতে গিয়ে নাগরিকদের ‘প্রমাণপত্র প্রদর্শন’-এর অলিখিত সমন তলব করা হচ্ছে। সরকার নয়, ভারতীয় সংবিধান তার ৩২৪ অনুচ্ছেদে নির্বাচন পরিচালনার জন্য যে প্রতিষ্ঠানকে অসীম ক্ষমতা প্রদান করেছে সেই নির্বাচন কমিশনও নয়, স্বাধীন ভারতের নাগরিকদেরই নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে হচ্ছে প্রশাসনের আদালতে দাঁড়িয়ে। ঘটনাচক্রে গত পরশু সংসদে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছে লিখিতভাবে প্রশ্ন করা হয়েছিল যে নাগরিকত্ব প্রমাণের উপযুক্ত নথি কী? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সে প্রশ্নের নির্দিষ্ট উত্তর দেয়নি।
এর আগেও দেশের বহু রাজ্যে বিশেষ নিবিড় সংশোধনীর মাধ্যমে পরিমার্জিত ভোটার তালিকা প্রস্তুত হয়েছে, প্রকাশিত হয়েছে, কিন্তু কখনও নির্বাচন কমিশনের বুথস্তরের প্রতিনিধি একটি ফর্ম সঙ্গে নিয়ে ভোটারদের বাড়ি গিয়ে ব্যক্তিগত নথিপত্র দেখতে চাননি, তাকে দিয়ে কোনও আবেদনপত্র পূরণ করাননি, এহ বাহ্য সেই আবেদনপত্র মন:পূত না হলে, কোনও কারণ না দর্শীয়ে অবলীলায় সেখানে ‘নট রেকমেনডেড’ লিখে সংশ্লিষ্ট ভোটারকে অ-নাগরিক করে দেননি।
একে নিছক প্রশাসনিক কাণ্ডজ্ঞানহীনতা বললে ভুল হবে। এটি নিছক কাগজপত্রের জটিলতা নয়, বরং এক অশুভ রাজনৈতিক পূর্বলক্ষণ। গণতন্ত্রের ভিত্তিকে নাড়িয়ে দেওয়ার মতো এক বিপজ্জনক সংকেত। একটি কথিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পতনের প্রথম পূর্বলক্ষণ, নির্বাচনি ব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতার অবক্ষয়। একদিকে আমরা দাবি করি, আধার জাতীয় নিরাপত্তা ও পরিচয় ব্যবস্থার মূল স্তম্ভ, অন্যদিকে নির্বাচন কমিশন নিজেই সেই স্তম্ভকে অগ্রাহ্য করে ভোটারকে সন্দেহের কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছে। ভোটার তালিকার এই বিশেষ নিবিড় সংশোধনী প্রক্রিয়া সত্যিই ভারী অদ্ভুত, যেখানে প্রাথমিক তালিকা থেকে বাদ যায় ৬৫ লক্ষ নাম, পক্ষান্তরে একটি নামও সংযুক্ত হয় না। প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক, জনকল্যাণমূলক কোনও কর্মযজ্ঞে যখন আধারকে উপজীব্য করে কোটি কোটি টাকা সরকার সরাসরি ব্যক্তির ব্যাঙ্কে স্থানান্তর করতে পারে, প্রায় একাশি কোটি মানুষকে নিখরচায় রেশন বিলি করতে পারে, রান্নার গ্যাসে ভর্তুকি দেওয়া যায়, তখন একই আধার ভোটারের পরিচয় নির্ধারণে অকেজো হবে কেন? নাকি এটি আসলে ‘প্রক্রিয়া’র নামে নতুন এক বাছাই? ইতিহাস সাক্ষী, যে দেশে ভোটারের অধিকার কাগজের আবেদনপত্র আর প্রশাসনিক জটিলতার জালে ফেলে দেওয়া হয়, সে দেশে গণতন্ত্রের প্রাণরস শুকিয়ে যেতে বেশি সময় লাগে না।
‘আধার’ প্রকল্পের স্লোগান ছিল ‘এক দেশ, এক পরিচয়’। কিন্তু বিহারে তার পরিণতি দাঁড়িয়েছে, ‘এক পরিচয়, বহু সন্দেহ’। গণতন্ত্রের চাবিকাঠি যে ভোট, সেই তালিকা যদি ধীরে ধীরে হয়ে উঠে অবিশ্বাসের দলিল, তবে গণতন্ত্রের দ্বীপ নির্বাপিত হতেও সময় লাগে না। হাঙ্গেরি থেকে তুরস্ক হয়ে ফিলিপিন্স সব দেশেই আমরা দেখেছি,ভোটাধিকার সংকোচনের সঙ্গে কীভাবে নাগরিক স্বাধীনতাও গিলেফেলে রাষ্ট্রশক্তি।আজ বিহারে যে আঁধার নেমে আসছে, সেটি শুধুমাত্র আধারের উপর নয়, বরং তা নেমে আসছে গণতন্ত্রের শিকড়ে।আর শিকড়ে যখন অন্ধকার জন্মায়, তখন পাতায় পচন ধরা কেবল সময়ের অপেক্ষা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *