August 14, 2025

স্মার্ট সিটি নাকি স্মেল সিটি?৫৪১ কোটির গন্ধে দমবন্ধ আগরতলা!!

 স্মার্ট সিটি নাকি স্মেল সিটি?৫৪১ কোটির গন্ধে দমবন্ধ আগরতলা!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-স্মার্ট সিটি প্রকল্পের আওতায় যে স্বপ্নের ছবি আঁকা হয়েছিল,আজ সেই ছবি যেন শুধু কাগজেই চকচমক করছে। বাস্তবে শহরময় এক নরক, অরাজকতা ও ভোগান্তি। সরকারী হিসাবে ৫৪১.০৪ কোটি টাকার বিশাল বরাদ্দ। কেন্দ্র দিয়েছে ৯০%, রাজ্য দিয়েছে ১০%। কিন্তু শহরবাসীর প্রশ্ন, এই টাকা শেষমেশ কোথায় যাচ্ছে?
বর্জ্য ব্যবস্থাপনা: প্রকল্পের তালিকায় রয়েছে আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সংস্থান। কিন্তু স্মার্ট সিটির সবজি লা, বাজারগুলোর সামনে গেলেই বুঝা যায় বাস্তবটা কী? বটতলা, গোলবাজার, লেক চৌমুহনী, মঠ চৌমুহনী প্রভৃতি শহরের প্রধান সবজি বাজারগুলোর সামনে প্রতিদিনই জমে থাকে পাহাড়সম ময়লা ও পচা সবজি,ফলমূলের স্তূপ। দুর্গন্ধে নাক টেকে না। পথচারী ও ক্রেতা-বিক্রেতাদের নাকে রুমাল চাপা দিয়ে যাতায়াত করতে হয়। গবাদি পশু ও সারমেয়র দল এই বর্জ্য ছড়িয়ে দিচ্ছে রাস্তায় ও ফুটপাথে। স্মার্ট সিটি প্রকল্পের আওতায় শহর উন্নয়নের কথা বলা হলেও বাস্তবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা চরমভাবে বেহাল। বাজার এলাকার ময়লা সংগ্রহের জন্য নির্দিষ্ট কন্টেইনার বা বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ ইউনিট না থাকায় পচনশীল জৈব বর্জ্য খোলা রাস্তায় ফেলে রাখা হয়। যা থেকে ছড়ায় মিথেন গ্যাস ও দুর্গন্ধ। পাশাপাশি আকৃষ্ট হয় মাছি ও ইদুরের মতো রোগবাহক প্রাণী।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাজার সংলগ্ন স্থানে বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট বা জৈব সার উৎপাদন ইউনিট স্থাপন করা যেত।তাতে একাধিক সমস্যা একসাথে সমাধান সম্ভব। বায়োগ্যাস প্রকল্পে বাজারের দৈনিক উৎপন্ন পচনশীল বর্জ্য যেমন-নষ্ট সবজি, ফলমূল, ফুল, খাদ্যবস্তু ইত্যাদি সংগ্রহ করে অ্যানায়েরোবিক ডাইজেশন প্রক্রিয়ায় প্রক্রিয়াকরণ করা হয়। এতে উৎপন্ন মিথেন গ্যাস রান্না, বিদ্যুৎ উৎপাদন বা ছোট মাপের শিল্প কারখানায় জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। অপরদিকে প্রক্রিয়ার উপজাত হিসেবে যে স্লারি বা জৈব বর্জ্য থাকে তা শুকিয়ে উচ্চ মানের জৈব সার হিসেবে কৃষকদের কাছে বিক্রি করা সম্ভব।
এই ধরনের প্রকল্প বাজার এলাকার পচনশীল বর্জ্যকে মাত্র ২৪-২৮ঘন্টার মধ্যে ব্যবহারযোগ্য শক্তি ও সারে রূপান্তরিত করে। ফলে খোলা রাস্তায় বর্জ্য জমে থাকার সুযোগ থাকে না। পাশাপাশি দুর্গন্ধ, পরিবেশ দূষণ, পোকামাকড় ও ইদুরের উপদ্রব উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। শহরের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা রক্ষা হয়।আর উৎপন্ন গ্যাস ও সার বিক্রি করে মিউনিসিপাল কর্পোরেশন ও স্থানীয় বাজার কমিটি বাড়তি রাজস্ব অর্জন করতে পারে।
পরিবেশবিদদের মতে, আগরতলার এই বড় বড় বাজারগুলিতে প্রতিদিন গড়ে ২-৩ টন পচনশীল জৈব বর্জ্য উৎপন্ন হয়। সঠিক প্রযুক্তি ব্যবহার করলে এই বর্জ্য থৈকে দৈনিক কয়েকশো ঘনমিটার বায়োগ্যাস এবং কয়েকশো কিলোগ্রাম জৈব সার উৎপাদন সম্ভব। এতে একদিকে নগর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আধুনিক ও কার্যকর হবে, অন্যদিকে শহরবাসী পাবে দুর্গন্ধমুক্ত বাজার এলাকা। যা প্রকৃত অর্থেই স্মার্ট সিটির লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই স্মার্ট ও আধুনিক কাজটি বাস্তবায়ন করার ব্যাপারে কোন উদ্যোগ এতদিনেও নেওয়া হয়নি।
এদিকে শহরের অলিগলি থেকে শুরু করে প্রধান সড়কের মোড়ে মোড়ে ডাস্টবিনগুলির অবস্থা বর্তমানে শোচনীয়। অধিকাংশ ডাস্টবিন ভাঙা, ঢাকনাবিহীন। ফলে পচা আবর্জনার দুর্গন্ধ চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। অনেক জায়গায় ডাস্টবিনের সংখ্যা অপ্রতুল হওয়ার অল্প সময়ের মধ্যে ময়লা উপচে রাস্তার গড়িয়ে পড়ছে। জনবহুল এলাকার পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। দিনের পর দিন আবর্জনার পাহাড় জমে থাকে রাস্তার উপর। কিন্তু সঠিক সময়ে সেগুলো অপসারণ হয় না।
শহরবাসীর অভিযোগ, আবর্জনা ও উচ্ছিষ্টের এই স্তূপে খাবারের সন্ধানে কুকুর, বিড়াল ঢুকে পড়ে এবং ময়লা ছড়িয়ে দেয় রাস্তায়। এর ফলে শুধু দুর্গন্ধই নয়, বর্ষাকালে নর্দমা ও ড্রেন আটকে জলাবদ্ধতারও সৃষ্টি হয়। খোলা ডাস্টবিনে জমে থাকা বর্জ্য থেকে মাছি, মশা ও ইদুরের মতো রোগবাহী পোকামাকড় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য গুরুতর হুমকি। এছাড়া, ডাস্টবিন থেকে ময়লা সংগ্রহকারী গাড়িগুলির অবস্থা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। স্থানীয়দের মতে, গাড়িগুলোতে যথাযথ ঢাকনা বা সিলিং ব্যবস্থা নেই। ফলে সংগ্রহের সময় গোটা রাস্তাজুড়ে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে এবং তরল বর্জ্য গড়িয়ে পড়ে সড়কে। এই তরল পদার্থ শুকিয়ে গেলে ধুলোর সঙ্গে বাতাসে উড়ে গিয়ে শ্বাসকষ্ট সহ নানা রোগ ছড়াচ্ছে।
রাস্তা উন্নয়ন ও সৌন্দর্যায়নঃ কিছু জায়গায় চকচকে টাইলস, লোহার রেলিংয়ে দামি রংয়ের ডবল প্রলেপ। কিন্তু ফুটপাথের একদিকে গর্ত অন্যদিকে ভাঙা স্ল্যাব। টিআরটিসি চৌমুহনী থেকে বিদুরকর্তা চৌমুহনী পর্যন্ত রাস্তার মাঝে ও দুই পাশে বসানো হয়েছে রোড স্টাড বা ‘ক্যাটস আই’। এই রাস্তা মূলত সিঙ্গল লেন এবং ওয়ানওয়ে। যেখানে স্বাভাবিক যান চলাচলের জন্য প্রস্থও সীমিত। ফলে সাধারণ নাগরিকদের প্রশ্ন, এত সংকীর্ণ ও একমুখী রাস্তায় মাঝ বরাবর রোড স্টাড বসানোর যৌক্তিকতা আসলে কতটুকু?
বিশেষজ্ঞদের মতে, রোড স্টাড মূলত রাত্রিকালীন বা কুয়াশাচ্ছন্ন পরিবেশে রাস্তার লেন চিহ্নিত করার জন্য ব্যবহার হয়। বিশেষ করে হাইওয়ে বা চওড়া মাল্টি লেন সড়ক। সংকীর্ণ ওয়ানওয়ে শহরে রাস্তায় এই সরঞ্জাম প্রয়োজনীয় নয় বলেই অনেকের মত। কারণ, এখানে লেন বিভাজনের জন্য পর্যাপ্ত জায়গা নেই এবং যান চলাচলও ধীরগতির। বরং, মাঝের রোড স্টাড ছোট গাড়ি, বাইক বা সাইকেল আরোহীদের জন্য হঠাৎ ধাক্কা বা ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি তৈরি করেছে। নগরবাসীর অভিযোগ, যেখানে শহরের বহু গুরুত্বপূর্ণ চৌমুহনী, ফুটপাথ ও নিকাশি ব্যবস্থা এখনও অব্যবস্থাপনার শিকার, সেখানে এই ধরনের অপ্রয়োজনীয় কাজ অর্থের অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়। কেউ কেউ মনে করছেন, এটি ঠিকাদার বা সাপ্লায়ারদের পক্ষে সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার জন্য পরিকল্পিতাবে করানো হয়েছে। শহর পরিকল্পনা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নগর অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ পরিকল্পনা সাপেক্ষ এবং প্রয়োজনভিত্তিক হওয়া উচিত। অপ্রয়োজনীয় স্থানে রোড স্টাড বসানো যেমন অর্থ অপচয়, তেমনই জননিরাপত্তার জন্যও প্রশ্নবিদ্ধ। নাগরিক মহলে দাবি উঠেছে, এই প্রকল্পের ব্যয়, প্রয়োজনীয়তা এবং অনুমোদন প্রক্রিয়া নিয়ে অবিলম্বে তদন্ত হোক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *