August 11, 2025

উন্নয়নে বিজ্ঞান নেই, আছে শুধু খরচের বাহার!!

 উন্নয়নে বিজ্ঞান নেই, আছে শুধু খরচের বাহার!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-আগরতলা স্মার্ট সিটি না ‘স্মাট’ ভাঁওতা? কাগজে-কলমে দশ বছর হতে চললো আগরতলা স্মার্ট সিটির বয়স। প্রচারে হইচই, সরকারী অনুষ্ঠানে বক্তৃতার ঝড়, কিন্তু শহরের রাস্তায় পা রাখলেই বাস্তব চিত্র চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় কাগজে-কলমে স্মার্ট হলেও মাটিতে তা জগাখিচুড়ি। শহরবাসীর মুখে তাই একটাই প্রশ্ন- এই কি তবে স্মার্ট সিটি?
২০১৬ সালে দেশের স্মার্ট সিটিজ মিশন-এ অন্তর্ভুক্ত হয় আগরতলা।
আসলে কতটা স্মার্ট হয়েছে এই শহর?
এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে দেখে নেওয়া যাক আসলে স্মার্ট সিটি কী?
স্মার্ট সিটি মানে কোনো বিশেষ স্থাপত্যশৈলী নয়। বরং প্রযুক্তিনির্ভর নগর ব্যবস্থাপনা। যেখানে টেকসই পরিকাঠামো,পরিবেশবান্ধব নকশা, দ্রুত নাগরিক সেবা, যানজট ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তা, ই-গভর্নেন্স, সবুজ এলাকা, স্মার্ট পরিবহণ ইত্যাদি থাকে। প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে রয়েছে- স্মার্ট ট্রাফিক সিস্টেম ও সিসিটিভি নজরদারি, দূষণ ও যানজট বিহীন রাস্তা, নিরাপদ ফুটপাথ ও জনপরিসর, রাস্তা পারাপারের নির্দিষ্ট জেব্রা ক্রসিং, পথচারীদের জন্য আন্ডারপাস এবং ওভারপাস, পরিবেশবান্ধব বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, ইলেকট্রিক বাস ও সাইকেল ট্র্যাক, সেন্সর-ভিত্তিক বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী ও স্ট্রিটলাইট, স্মার্ট বিল্ডিং রেইনওয়াটার হার্ভেস্টিং ইত্যাদি।
যেখানে এসব বৈশিষ্ট্যগুলি বাস্তবায়িত হওয়া দরকার, সেখানে আগরতলা শুধু নামে স্মার্ট, কাজে ঠাণ্ডা চা। স্মার্ট সিটি মানে হওয়া উচিত আধুনিক, প্রযুক্তিনির্ভর, পরিচ্ছন্ন ও পরিকল্পিত নগর জীবন। কিন্তু আগরতলায় যা হয়েছে, তা যেন কিছু সিসিটিভি, এলইডি লাইট, প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে রাস্তার উপর যত্রতত্র কেটস আই বা রোড স্টাড, কয়েকটা পার্ক রঙ করে দেওয়া ইত্যাদি। স্মার্ট ট্রাফিক সিগন্যাল আছে, কিন্তু বেশ কিছু সচল নয় বা রিয়েল টাইম পরিচালিত নয়। ই-গভর্নেন্স আছে, কিন্তু কাজ অর্ধেক। যানজট, অবৈধ পার্কিং, ফুটপাথ দখল- সব আগের মতোই।
যেখানে সমস্যা সেখানেই উদ্ভট ও নির্বোধের মতো সরকারী কার্যকলাপ। এডি নগর সিএনজি স্টেশনে গ্যাস ভরতে ঘন্টার পর ঘন্টা মূল সড়কে লাইনে আটকে থাকছে গাড়ি। রাস্তা চওড়া করার সুযোগ আঘে। কিন্তু সরকারের হুঁশ নেই। এডি নগর শিল্পাঞ্চল শহরের বাইরে সরিয়ে গাড়ি চলাচল স্বস্তি দিতে পারতো। তার বদলে নেরাম্যাকের সামনে নতুন দ্বিতল মার্কেট স্টল! ভবিষ্যতে এখানে বাজার বসবে, যানজট হবে- এ কথা বুঝতে কি বিশেষজ্ঞ লাগবে?
এডিনগর ড্রপ গেটের রাউন্ডএবাউট বারবার ভেঙে নতুন করে বানানো হয়েছে। তবুও অবৈজ্ঞানিক চৌমুহনী রয়ে গেছে। পরিকল্পিত বাসস্টপ নেই। যেখানে সেখানে বাস দাঁড়ায়। ফুটপাথে কোথাও যাত্রী প্রতীক্ষালয়, কোথাও বন জঙ্গল ও গাছের ডালপালা। ফলে পথচারীকে নামতে হচ্ছে রাস্তায়। যানবাহনের ধাক্কায় হাত-পা ভাঙছে, মরছে মানুষ। সরকারের গায়ে আঁচ নেই।
পুলিশের ডিউটির জন্য বটতলামুখী ড্রপ গেটে মূল রাস্তার উপর টিনের একচালা ঘর বানানো হয়েছে, পিছনে স্থায়ী ঘর ফাঁকা পড়ে থাকলেও। নেতা-মন্ত্রীদের প্রচারের জন্য রাস্তার উপর যানবাহন চলাচলের রাস্তা দখল করে তোরণ, সুবিশাল গেট। যেন যানজট বাড়ানোই মূল লক্ষ্য।
ফুটপাথ দখল আর সরকারী উদাসীনতা এই শহরের বহু পুরনো রোগ।হাওড়া সেতু থেকে শুরু করে জয়নগর মধ্য রাস্তা অবধি, ফায়ার ব্রিগেড থেকে অফিস লেনের মুখ অবধি মানুষ চলাচলের ফুটপাত হকারদের দখলে। খােদ আদালত কমপ্লেক্স লাগোয়া পশ্চিম পাশে ফুটপাথের উপর হকারদের ঠেলা, চা স্টল।যার যেমন ইচ্ছা করুক, গাড়ির ধাক্কায় মরুক- এই মন্ত্রে চলছে শহর।
বিদুরকর্তা চৌমুহনীর ফুটপাথে ট্রান্সফর্মার আর ওয়াশরুম! কর্নেল চৌমুহনী পর্যন্ত ফুটপাথ দখল করে ব্যবসায়িক সাইনবোর্ড, বাইক ও পসরা স্ট্যান্ড। উত্তর গেটে বিএসএনএল অফিসলাগোয়া ফুটপাথে, শান্তিকামী সংঘের কাছে ফুটপাথে বড় বড় গাছ। রাধানগর থেকে সার্কিট হাউস ফুটপাথই নেই।
যেখানে ফুটপাথ আছে, সেখানে হাঁটার জায়গা নেই। বড় বড় গাছ, খুঁটি, বা অবৈজ্ঞানিক প্রতীক্ষালয়। আবার বহু গুরুত্বপূর্ণ রাস্তায় ফুটপাথই নেই। আস্তাবলে নির্মিত নতুন ব্রিজে পর্যন্ত ফুটপাথ নেই। এ অনুমতি কে দিল? রাধানগরমুখী উত্তর গেটের কাছে বাসস্টপ নেই। আছে ‘পার্কিং’ বোর্ড। ফলে সারাদিন বাইক, গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে সেখানে। বাস থামতে বাধ্য হয় রাস্তায়। পার্কিং এবং বাস স্টপ-এ দুটি এক নয়। ট্রাফিক কর্তারা কবে জানবে?
শহর পরিকল্পনার নামে কাগুজে উন্নয়ন। সরকারের পরিকল্পনা যেন ‘টাকা আসুক, খরচ হোক, ফল যা হয় হোক’। উন্নয়ন প্রকল্পে কোটি কোটি টাকা ঢালছে কেন্দ্র। আর তার ফল হচ্ছে কিছু ফুটপাথেও রেলিংয়ে রং লাগানো আর স্মার্ট সিটির সাইনবোর্ড। যানজট, দূষণ, আবর্জনা ও বর্জ্যের ছড়াছড়ি, অবৈজ্ঞানিক নির্মাণ- সব রয়ে গেছে।
যার ফলে এক নোংরা সংস্কৃতির শহরে পরিণত হয়েছে আগরতলা। এই অরাজক পরিবেশেই বড় হচ্ছে নতুন প্রজন্ম। রাস্তা ও ফুটপাথ দখল, বিশৃঙ্খল ট্রাফিক, দুর্বার গতি, যত্রতত্র আবর্জনা ছুড়ে ফেলা, যত্রতত্র মদের আসর, নিয়ম ভাঙা যেন এখন স্বাভাবিক সংস্কৃতি। পূর্বতন বাম সরকার হোক বা বর্তমান ডবল ইঞ্জিনের সরকার- কেউই চোখ খুলে দেখেনি। নিয়ম নেই, কঠোর আইন নেই,সচেতনতার অভাব প্রকট।
আগরতলার মধ্য দিয়ে রাজ্যের উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণাংশের সংযোগের প্রধান করিডর সার্কিট হাউস থেকে এডিনগর ড্রপ গেট। এই প্রধান করিডরটি হলো, আইজিএম চৌমুহনী – টিআরটিসি চৌমুহনী-বিদুরকর্তা চৌমুহনী – কর্নেল চৌমুহনী – হারাধন সংঘ – উত্তর গেট হয়ে সার্কিট হাউস। এত গুরুত্বপূর্ণ রাস্তায় অবহেলার চিত্র স্পষ্ট।এটাই প্রমাণ,’স্মার্ট সিটি’ স্লোগান শুধু প্রচারের জন্য, নাগরিক স্বার্থের জন্য নয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *