August 2, 2025

এ তদন্ত কি যথার্থ?

 এ তদন্ত কি যথার্থ?

গত মাসে আহমেদাবাদে ঘটে যাওয়া বোয়িং স্ট্রিমলাইনার বিমান দুর্ঘটনার প্রাথমিক তদন্ত রিপোর্ট সরকার অনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করার আগে কী করে সংবাদমাধ্যমে ফাঁস হল,সে প্রশ্ন অবান্তর।সাম্প্রতিক-অতীতের সবচেয়ে মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনার এই তদন্ত রিপোর্ট উত্তরের থেকে আদতে অধিক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।কারণ, বিমান দুর্ঘটনার দায় মৃত দুই পাইলটের ঘাড়ে কার্যত চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। তদন্তে উঠে এসেছে ককপিটের জ্বালানি সুইচ ঘিরে দুই পাইলটের মধ্যে ‘বিভ্রান্তি’ কথা।
তদন্তকারী সংস্থা ‘এয়ারক্রাফট অ্যাক্সিডেন্ট ইনভেস্টিগেশন ব্যুরো’ (এএআইবি) প্রাথমিকভাবে এই দুর্ঘটনার দায় সম্পূর্ণরূপে দুই মৃত পেশাদার কর্মীর কাঁধেই চাপিয়ে দিতে চেয়েছে।ফলে প্রশ্ন উঠছে,এটি কি সত্যিই একটি নিরপেক্ষ তদন্তের প্রতিচ্ছবি, নাকি দায় এড়ানোর সহজ রাস্তা? প্রথমেই বলা জরুরি, কোনও বিমান দুর্ঘটনা কেবলমাত্র একজন বা দুইজন পাইলটের ভুলে ঘটে না। বিমান একটি বহুমাত্রিক প্রযুক্তিনির্ভর পরিবহণ ব্যবস্থা। এখানে পাইলট ছাড়াও নিয়ন্ত্রণ কক্ষ, এটিসি, রুট ম্যানেজমেন্ট, আবহাওয়ার পূর্বাভাস, রক্ষণাবেক্ষণ সংস্থা ও নির্মাতা প্রতিষ্ঠান, বহু পক্ষের মিলিত একটি সমন্বিত চক্র কাজ করে। এই চক্রের যে কোনও একটি কড়ি দুর্বল হলে, পুরো ব্যবস্থার উপর তার প্রভাব পড়ে। সুতরাং শুধুমাত্র ককপিটের ভিতরের ভুল সিদ্ধান্তকেই একমাত্র দায়ী করা একেবারেই সরলীকরণ। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে, পাইলটদের দোষারোপ করার মধ্যে একটি ভয়ঙ্কর প্রবণতা থাকে, তারা আর জীবিত নেই, তাই নিজেদের পক্ষে কিছু বলার সুযোগও নেই। একপ্রকার ‘নিরাপদ সন্দেহভাজন’ ধরে নিয়েই তাদের বিরুদ্ধে নির্লজ্জ অভিযোগ তোলা হয়। অথচ অতীত বলছে, এই রকম বহু ঘটনার পরে যখন তথ্য প্রকাশ্যে আসে, তখন দেখা যায় বিমান প্রস্তুতকারী সংস্থা, রক্ষণাবেক্ষণ ইউনিট বা এমনকী নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ভুল সিদ্ধান্তই ছিল মূল কারণ।
২০১৮-১৯সালের বোয়িং ৭৩৭ ম্যাক্স সিরিজের দুটি মারাত্মক দুর্ঘটনায় প্রথমে পাইলটদের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল।কিন্তু পরে তদন্তে দেখা যায়, বোয়িংয়ের নিজস্ব সফটওয়্যার এমসিএএস- যে অ্যালগোরিদমটি ব্যবহার করছিল, সেটিরই গুরুতর ত্রুটির কারণে বারংবার বিমান ভুলভাবে সেটির অভিমুখ নামিয়ে দেয়, যা শেষ পর্যন্ত পাইলটদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এমনকী বোয়িং নিজেও এই গাফিলতির দায় স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল। তাহলে প্রশ্ন জাগে, এই স্ট্রিমলাইনার বিমানটি নিয়ে কি যথাযথ কারিগরি বিশ্লেষণ করা হয়েছে? ফ্লাইট ডেটা রেকর্ডার ও ককপিট ভয়েস রেকর্ডারের তথ্য কি স্বচ্ছতার সঙ্গে প্রকাশ করা হয়েছে?
এই তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ্যে চলে আসার পরে আমেরিকার অসামরিক বিমান নিয়ন্ত্রণ সংস্থা এফএএ এবং বিমান নির্মাতা সংস্থা বোয়িং বিবৃতি জারি করে দাবি করেছে, ইঞ্জিনে জ্বালানি নিয়ন্ত্রক সুইচের লকে কোনও গণ্ডগোল নেই এবং সেগুলির ব্যবহার বিপজ্জনক নয়। এতদসত্ত্বেও প্রশ্ন, সংশ্লিষ্ট দুই মার্কিন প্রতিষ্ঠানও কি দায় এড়াতে সচেষ্ট? সংশ্লিষ্ট বিমানটির শেষবার রক্ষণাবেক্ষণ কবে হয়েছিল? আবহাওয়ার অবস্থা কেমন ছিল? কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর ন্যাভিগেশন সিস্টেম কি ভুল নির্দেশনা দিয়েছিল? এই প্রশ্নগুলির সদুত্তর নেই রিপোর্টে।
বর্তমান সময়ে পাইলটদের উপর প্রচণ্ড মানসিক ও শারীরিক চাপ পড়ে।বিমান সংস্থাগুলি বাজারের চাপে পাইলটদের টানা ডিউটিতে নিযুক্ত করে রাখে। দীর্ঘ সময় ধরে অপ্রতুল বিশ্রামে থাকা পাইলট যখন ককপিটে বসেন, তখন তার সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও মনঃসংযোগে স্বাভাবিকভাবেই প্রভাব পড়ে। এই মানবিক দিকটি প্রাথমিকতদন্তে কতটা গুরুত্ব পেয়েছে, সেটিও প্রশ্নসাপেক্ষ। একই সঙ্গে, সংবাদ মাধ্যমের একাংশের ভূমিকাও পর্যালোচনার দাবি রাখে। প্রাথমিক রিপোর্ট প্রকাশের পরেই একাধিক সংবাদমাধ্যম ‘পাইলটের ভুল’ শিরোনাম সহযোগে এমন ভঙ্গিমায় ‘ব্রেকিং নিউজ’ এর দৌড়ে অবতীর্ণ হয়, যেন কোনও সামাজিক বিচারের পর্ব মঞ্চস্থ হচ্ছে। অথচ, একজন কর্মরত পাইলট যে কত ঘন্টার ট্রেনিং, কত ধরনের সিমুলেশন টেস্ট, আর কতটা দায়িত্বের মধ্যে দিয়ে তার কাজ করেন তা অনেকের জানা নেই। তাদের জীবনের শেষ সিদ্ধান্তকে ‘ত্রুটি’ বলা হলে, তা হতে হবে কঠোর প্রমাণভিত্তিক।
এই প্রেক্ষাপটে আমরা আশা করব, চূড়ান্ত তদন্ত রিপোর্টে প্রযুক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক দায় ঠিকভাবে নিরূপণ করা হবে। কারন দোষ চাপানো সহজ, কিন্তু সত্য উদ্‌ঘাটন কঠিন। একটি দুর্ঘটনার তদন্ত যদি কেবল ‘কে দোষি’ সেই খোঁজে সীমাবদ্ধ থাকে, তবে সত্যের পরিসর সংকীর্ণ হয়ে যায়। কিন্তু যখন ‘কেন এই দুর্ঘটনা ঘটল’ সেই প্রশ্নকে কেন্দ্র করে তদন্ত সংগঠিত হয়, তখনই সমাজ নিরাপদ হয়, ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী হয় এবং ভবিষ্যতের সম্ভাব্য প্রাণহানির পথ রুদ্ধ হয়। আহমেদাবাদের মতো মর্মান্তিক ঘটনা শুধু একটি দুঃখজনক স্মৃতি নয়, তা একটি শপথ, তথ্য চাপা নয়, সত্য উন্মোচনই হোক প্রাধান্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *