August 2, 2025

ইতিহাসবোধ বনাম সংকীর্ণতা!!

 ইতিহাসবোধ বনাম সংকীর্ণতা!!

সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাসও বদলে যায়।বদলে যায় পাঠ্যপুস্তক, ইতিহাসে সঙ্গে সাহিত্যের বই।এমন নতুন শিক্ষানীতির ও রচিত হয়। আসলে ছাত্রদের প্রয়োজনে বই লেখা হয় না। রাজনীতির প্রয়োজনেই স্কুলের পাঠক্রম, সিলেবাস, পাঠ্যপুস্তক তৈরি করা হয়। তাই পাঠ্যবই নিয়ে এদেশে বিতর্ক নতুন কোন বিষয় নয়। ইতিপূর্বে বিভিন্ন সময়ে সরকার ও বিরোধী দলগুলোর মধ্যে স্কুলের পাঠ্যপুস্তক নিয়ে চরম রাজনৈতিক লড়াই হয়েছে। কিন্তু তাই বলে তুচ্ছ রাজনীতি পাঠ্যপুস্তকের পিছু ধাওয়া করা ছাড়েনি।
ভারতীয় সংবিধানে শিক্ষাকে যুগ্ম তালিকায় স্থান দেওয়া হলেও শিক্ষাব্যবস্থায় বরাবরই রাজনীতির দাপাদাপি কমানো যায়নি।বেশিদূর বিতর্কে গিয়ে লাভ নেই।গত একুশ শতকের গোড়ার দিকে যখন অটল বিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বে কেন্দ্রে বিজেপি সরকার ক্ষমতাসীন,তখন দেশের মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী ছিলেন মুরলী মনোহর যোশী।অত্যন্ড পণ্ডিত এবং দেশের বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী হিসাবে জনমনে সুপরিচিত ছিলেন তিনি। তিনিও দেশের চিরাচরিত শিক্ষাব্যবস্থায় বড়সড় কিছু বদল আনতে চেয়েছিলেন। বলেছিলেন ভারতের ইতিহাস নতুন করে লেখা দরকার। তার নির্দেশনা ও সুপারিশে কেন্দ্রীয় শিক্ষা বোর্ডের পাঠ্যপুস্তকে আমূল পরিবর্তন আনা হয়েছিল। সেই সময় এনসিইআরটির বইয়ে ইসলামিক ভারত এবং সুলতানি সাম্রাজ্য ও মোঘল শাসন আমুলের ইতিহাসকে যথাসম্ভব ছোট করে সেই জায়গায় অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল রাজপুত ও মারাঠা রাজাদের ইতিহাস। পাঠ্যপুস্তক নিয়ে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সময়কালেও বিতর্ক হয়েছিল, মুরলী মনোহর যোশীর সময়কালেও বিতর্ক হয়েছে। কিন্তু সম্প্রাতিক কালে ব্যক্তিবন্দনা, ব্যক্তিপুজো, নেতার গুণগান প্রচারের আধিক্য যেভাবে ইতিহাস বই ও পাঠ্যপুস্তকে স্থান পাচ্ছে তা নিয়েই শিক্ষাবিদদের মধ্যে আশঙ্কার জন্ম দিচ্ছে। শুধু কেন্দ্রীয় সরকারই নয়, বেশী কিছু রাজ্য সরকারও ইদানিং ইতিহাসের ধারা বদলে দেওয়ার খোলাখুলি প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। শুধু ইতিহাস, রাজরাজাদের কাহিনীই শুধু বদলে দেওয়া হচ্ছে না, বদলে দেওয়া হচ্ছে সমাজবিজ্ঞান ও সাহিত্যের বিষয়গুলো। উত্তরপ্রদেশে পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা। অথচ পরিবর্তে সেখানে স্থান পাচ্ছে বাবা রামদেবের রচনা। আবার দক্ষিণ ভারতের পাঠ্যপুস্তক থেকে টিপু সুলতানকে ছেঁটে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে। এই ঘটনাক্রম থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার, এই ইতিহাসের ধারাবদলের চেষ্টার পেছনে যতটা না ইতিহাসবোধ আছে, তার চেয়ে অনেক বেশি মাত্রায় সক্রয় সংকীর্ণ রাজনৈতিক সমীকরণ।
ঘটনা হলো পাঠ্যবই বিতর্ক এবার নতুন মাত্রা এনেছে রাজস্থানে।’স্বাধীনতার পরের সোনালী ভারত’ নামে দ্বাদশ শ্রেণীর একটি ইতিহাস বই সম্প্রতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে রাজস্থান সরকার। শিক্ষামন্ত্রীর অভিযোগ, এই ইতিহাস বইটিতে কংগ্রেস নেতাদের অতিরিক্তভাবে মহিমান্বিত করা হয়েছে এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অবদানের বিষয়টি প্রায় অনেকটাই উপেক্ষা করা হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রীর মতে, গোটা বইটাই সাজানো হয়েছে এমন ভাবে যেন কংগ্রেসই একমাত্র দল যারা দেশের জন্য কিছু করেছে। আবার এই পাঠ্যবইয়ের আকবরের মতো চরিত্রের উপস্থিতি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন শিক্ষামন্ত্রী। ঘটনা হল, এই শিক্ষাবর্ষের জন্য ইতিমধ্যেই ৫ লক্ষ কপি বই ছেপে ফেলা হয়েছে। ১৯,৭০০ স্কুলে বই বিলি করাও হয়ে গেছে। এখন পাঠ্যবই বিতর্কের এই রাজনীতি এবং একরৈখিক ইতিহাস লেখার অভিযোগের জেরে গচ্ছা যাবে বহু কোটি টাকা। শিক্ষাবর্ষের অর্ধেক পেরিয়ে কেন মন্ত্রীবাবুদের এত দেরিতে হুঁশ ফেরে সেটাও প্রশ্নের। মন্ত্রী অসন্তোষ ব্যক্ত করেছেন এই ভাবে, এক দশকের বেশি সময় দেশ চালাচ্ছেন মোদি। ৩৭০ ধারা বিলোপ হয়েছে, রামমন্দির নির্মাণ হয়েছে, জাতীয় উন্নয়নে অনেক অবদান রেখেছে সরকার- কিছু সেটা ইতিহাস বইয়ে থাকবে না কেন? মোদ্দা কথা ‘আজাদি কা বাদ কা স্বর্ণিম ভারত’ই হোক’ কিংবা নেতাদের মহিমা কীর্তন-স্কুলের পাঠ্যবই এখন আর ছাত্রছাত্রীদের প্রয়োজনের নিরিখে তৈরি হয় না। আর সেটা হয় না বলেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতাও স্থান পেয়ে যায় স্কুলপাঠ্যে। বাবা ভীমরাও আম্বেদকর চেয়েছিলেন সংবিধানের মাধ্যমে যথাসম্ভব শিক্ষাকে রাজনীতিমুক্ত রাখতে। সেই ব্যবস্থা করাও হয়েছিল সংবিধানের অনুচ্ছেদে। কিন্তু যে দেশে নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের সঙ্গে রাজনীতির জড়িয়ে থাকে সেখানে রাজনীতিমুক্ত শিক্ষার কল্পনাটুকুও অসার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *