September 17, 2025

যুদ্ধে কার লাভ কার ক্ষতি!!

 যুদ্ধে কার লাভ কার ক্ষতি!!

ইরান-ইজরায়েল যুদ্ধে এখন বিরতি চলছে।ধরে নেওয়া যাক, এই যুদ্ধ আর এগোবে না, কারণ ইজরায়েল আর হামলার সাহস করবে না। অন্যদিকে ইরান তার পরমাণু কর্মসূচি চালিয়ে যাবে। তাহলে বারোদিনের যুদ্ধের ফলাফল কী দাঁড়ালো। অনেকে বারোদিনের হামলা, পাল্টা হামলার পর যে পরিস্থিতি সামনে এসে দাঁড়িয়েছে তাকে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি বলে মনে করছেন, সেইভাবেই দেখতে চাইছেন। অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঘটনাক্রমের সঙ্গে মেলাতে চাইছেন। ১৯৪০ সালের নভেম্বর মাসে ব্রিটেনের উপর জার্মানি যে বিমান হামলা চালিয়েছিল তাকে জার্মান প্রযুক্তিগত এক চমৎকার সাফল্য বলে দাবি করে। জার্মানির প্রচার সচিব জোসেফ গোয়েবলস এই হামলাকে গোটা যুদ্ধের মধ্যে ভয়াবহতম বলে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। কিন্তু এই হামলার পর খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি ব্রিটেনকে। তাদের বিমান উৎপাদন কারখানাগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ধ্বংস হয়ে যায়নি। সেগুলিকে উৎপাদনক্ষম করে নিয়ে কয়েক মাসের মধ্যেই পাল্টা হামলা চালায়। সেদিন জার্মানদের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল ব্রিটিশদের মনোবলকে খাটো করে দেখা। ব্রিটিশরা যে ফের এরকম দুর্দমনীয় হয়ে উঠবে তা তারা ভাবতেই পারেনি।
সেই দিনের জার্মানির ভূমিকায় আজ ইজরায়েল। ইরানে প্রথম হামলার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ইজরায়েলের সামরিক বাহিনী ‘সম্পূর্ণ বিজয়’ বলে দাবি করে। আর বারোদিন যুদ্ধ চলার পর ইজরায়েল কৌশলগত পরাজয়ের সম্মুখীন। ডোনাল্ড ট্রাম্প যুদ্ধবিরতি ঘোষণা দিয়ে দুই পক্ষকে প্রতিশ্রুত করার চেষ্টা করলেও ইজরায়েল তা মানতে চাইছে না। ইজরায়েলের গাঁইগুই থামাতে ট্রাম্পকে প্রায় প্রকাশ্যে ধমক দিতে হচ্ছে। কেন ইজরায়েলের এই অস্বীকৃতি? তাদের অস্বীকৃতি থেকে বুঝা যায়, যে তিন বা ততোধিক উদ্দেশ্য নিয়ে যুদ্ধে নেমেছিল ইজরায়েল তার কোনওটাই সাধিত হয়নি। প্রথমে ইজরায়েল ও পরে আমেরিকা ইরানের পরমাণু ক্ষেত্রে হামলা চালিয়ে সেগুলি ধ্বংস করে দেওয়ার দাবি জানালেও সেই দাবির সপক্ষে কেউই কোনও প্রমাণ দেখাতে পারেনি। এক সূত্রে বলা হচ্ছে ইরান সম্ভাব্য হামলার আশঙ্কা আগেই করেছিল এবং পরমাণু ক্ষেত্র থেকে সেন্ট্রিফিউজ সরিয়ে নিয়েছিল। অন্য সূত্রে জানা যায়, ইরানের হাতে চারশো কেজিরও বেশি সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম মজুত রয়েছে। বস্তুত দুটি তথ্যই ধারণামূলক। কোনটা কতটুকু সত্য তা কারোরই জানা নেই।
ইজরায়েলের হামলার দ্বিতীয় যুদ্ধ – লক্ষ্য হলো ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রগুলি যাতে কোনওভাবেই তার দেশের জন্য হুমকির কারণ না হতে পারে। অথচ দেখা গেছে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের যুদ্ধবিরতি ঘোষণার কিছুক্ষণের মধ্যেই ইরান যে মারাত্মক ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণ করে দেয়, তাতে সে প্রমাণ করতে চেয়েছে, ক্ষেপণাস্ত্রগুলি তৈরিই আছে, নিঃশেষ হয়ে যায়নি। তৃতীয়ত, নেতানিয়াহু চেয়েছিলেন এই যুদ্ধের মাধ্যমে তার দেশের ঘরোয়া অসন্তোষ যেন চাপা পড়ে যায়। এক বৃহস্পতিবার ইজরায়েলের সংসদে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে বিরোধীরা অনাস্থা আনেন। প্রচার ছিল, এই দফায় নেতানিয়াহুর বহুদলীয় জোটের সরকারের পতন অনিবার্য। দেশে মধ্যবর্তী নির্বাচন আসছে। কিন্তু বিরক্ত কিছু জোট শরিক শেষ মুহূর্তে নেতানিয়াহুকে ক্ষমাঘেন্না করায় সামান্য ব্যবধানে জয়ী হন নেতানিয়াহু, আর এর পরদিন অর্থাৎ শুক্রবারেই হামলা চলে ইরানের পরমাণুক্ষেত্র ও সেনাবাহিনীর ডেরায়। সেনাপ্রধান, পরমাণু বিজ্ঞানী সমেত আটজন শীর্ষ পদাধিকারীকে হত্যা করা হয় সেদিন।
কিন্তু ঘটনাক্রম দেখিয়েছে যাদের হত্যা করা হলো সেই সব শূন্যপদ তৎক্ষণাৎ পূরণ করে নেয় ইরান। ইজরায়েলের বিরুদ্ধে মুখভাঙা জবাব দিতে তাদের কোনও অসুবিধা হল না। এতে ইজরায়েলে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে ঘরোয়া অসন্তোষ এখন বাড়লো বই কমেনি। কারণ যুদ্ধে দেশটির বিশাল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এর জবাবদিহি করতে হবে নেতানিয়াহুকে। তাছাড়া প্রচার যাই থাকুক, ডোনাল্ড ট্রাম্প যুদ্ধবিরতি ঘোষণা দেওয়ার কয়েকদিন আগে থেকেই বুঝা যাচ্ছিল, ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পুরোপুরি প্রস্তুত নয় নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন ইজরায়েলি সেনাবাহিনী। এই ঘটনাগুলি আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নেতানিয়াহুকে পিছিয়ে দিলো। এখানেই ব্রিটেনের বিরুদ্ধে জার্মানির সেই কৌশলগত পরাজয়ের ইতিহাস ফিরে আসে। ট্রাম্প যুদ্ধবিরতি ঘোষণা দেওয়ার পর ইদানীং গাজায় হামাসবাহিনী ফের সক্রিয় হতে চাইছে। যদি এই ঘটনা চলতে থাকে সেটি হবে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। গত দুই বছর ধরে ইজরায়েল যুঝে চলেছে হামাস, হিজবুল্লার সঙ্গে। তাদের দেশি রকেট হামলায় ইজরায়েল যতটা ক্ষতিগ্রস্ত তার হাজার হাজার গুণ ক্ষতির শিকার হতে হলো এই যুদ্ধে। ইজরায়েলের নাগরিকরা নিজেদের চোখের সামনে দেখতে পেলেন ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রে কীভাবে ধসে পড়ছে ঘরবাড়ি।
সম্প্রতি পেন্টাগন ইরানে হানাদারির একটি পর্যবেক্ষণে বলেছে, মার্কিন হানায় ইরানের তিনটি পরমাণুক্ষেত্র ধ্বংস হয়ে যায়নি। হয়তো মাস ছয়েকের জন্য তাদের পরমাণু কর্মসূচি থমকে যাবে। অন্যদিকে ইজরায়েল বারবার ন এই পরমাণু ক্ষেত্রগুলিতে হামলা চালিয়েও তেমন কোনও ক্ষতি করতে পারেনি। অন্যদিকে ইরান তার ক্ষেপণাস্ত্রগুলির লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে তেল শোধনাগার এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলিকে। তেহরানের দাবি, ইজরায়েলের সামরিক ক্ষেত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যদিও ইজরায়েল তা স্বীকার করে না। ফলে বারোদিনের যুদ্ধে ইজরায়েলের বহিরঙ্গের ক্ষতি যা দৃশ্যমান তার চেয়েও বড় ক্ষতি-ইরানের উপর হামলায় তাদের যে যুদ্ধলক্ষ্য ছিল তার কোনওটাই ভেদ হল না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *