বাংলাদেশি পোশাকসহ ৭ পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করল ভারত !!
অপারেশন জাতিগণনা!!

প্রধানমন্ত্রী মোদি বলিয়াছিলেন অপারেশন সিন্দুর শেষ হইয়া যায় নাই। অর্থাৎ পাকিস্তানকে শিক্ষা দেওয়ার কাজটি আবার চলিবে।দেশের অধিকাংশ মানুষ মনে করেন অন্তত পহেলগাঁওয়ের চার সন্ত্রাসীর হিসাব-নিকাশ না হওয়া পর্যন্ত ঘরে ফিরিয়া আসা অর্থহীন।সিন্দুরের মর্যাদা আর জবাকুসুম তেলের বাণিজ্য এক কথা হইতে পারে না। যদিও ট্রাম্পের কথায় অপারেশন বন্ধ করিয়া দেশের প্রধানমন্ত্রী মোদি আজ দেশবাসীর প্রশ্নের সম্মুখীন। সেই প্রশ্নবাণ ঘরে-বাহিরে সর্বত্রই তীব্রতর। বাহিরে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রচারে দেশে দেশে দৌত্য পাঠাইবার কথা ভাবিতেছে সরকার। সহজেই অনুমেয় ভারতকে বিশ্বগুরু করিবার যে পণ লইয়াছিলেন আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বিশ্ব দরবারে তাহার সেই যাত্রা খানিক হইলেও শ্লথ হইয়াছে। আজ পাকিস্তানে সন্ত্রাসবিরোধী প্রত্যাঘাতেই আমরা তাহাকে একা হইয়া পড়িতে দেখিয়াছি। অবশ্য পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অতীতেও ভারত একার জোরেই লড়িয়াছে। ১৯৯৮-৯৯ সালেও ভারত একা বুক চিতাইয়া লড়িয়াছিল এবং বিজয় পাইয়াছিল। প্রধানমন্ত্রী মোদি বলিয়াছিলেন, এই দফায়ও সেই লড়াই এখনো শেষ হইয়া যায় নাই।
ঘরের বাহিরে যখন এই লড়াই ঘরের ভেতরেও এক অবিশ্বাস্য লড়াই শুরু হইয়াছে। এই বৎসরের শেষ প্রান্তে বিহার রাজ্যে বিধানসভার নির্বাচন। এই নির্বাচনে জয়লাভ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের তুলনায় কম গুরুত্বপূর্ণ নহে, ইহা বুঝা গেল পহেলগাঁওয়ের হামলার পর এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রত্যাঘাত শুরুর পর- এই সময়ের মধ্যে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর দুই দফায় বিহার সফর এবং বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধীর এক দফায় বিহার সফরে। পহেলগাঁওয়ের ‘বদলা’ কবে কীভাবে লওয়া হইবে এবং এই লইয়া সারাদেশে আলোচনা যখন চরমে তখন আচমকাই কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষণা করিয়া দেয়, পরবর্তী জনগণনার সময় দেশে জাতিগণনাও করা হইবে। যুদ্ধ আবহে ও জল্পনায় প্রতিটি ভারতীয়ের কাছে এই ঘোষণার আকস্মিকতা ছিল অভাবনীয়, কারণ এমন অস্থির সময়ে ওই ঘোষণা কেহ প্রত্যাশা করে নাই। আবার ঘোষণাটি দিল যেই দলের সরকার, তাহারা জন্মকাল হইতে জাতিগণনার বিরোধিতা করিয়া আসিতেছে। যুদ্ধের আবহ যখন খানিক ঝিমাইয়া আসিতেছে তখন কিন্তু অ্যান্টিক্লাইম্যাক্স লইয়া রাজনৈতিক চর্চা জোরালো হইতে বাধ্য এবং হইতে শুরু করিয়াছে।
বিজেপি বরাবরের নীতি ও আদর্শগতভাবে জাতগণনার বিরোধিতা করিয়া আসিতেছে। তাহারাই কেন ভোল পাল্টাইয়া এই সিদ্ধান্ত নিল- এই প্রশ্ন আলোড়ন তুলিতেছে। কংগ্রেস দু-তিন বৎসর নিয়মিত জাতিগণনার দাবি জানাইতেছে। তাহাদের জন্যও ইহা নূতন। ইতিহাসে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ১৯৫১ সালে প্রথম জনগণনার জাতিগণনা না করিবার সিদ্ধান্ত লইডা জাতপাতবিহীন নূতন ভারত গড়িয়া তুলিবার কথা বলেন। ২০১১ সালে মনমোহন সিংয়ের জমানায় জাতগণনা ছিল ঐচ্ছিক। গণনাশেষে সরকার নানাবিধ কারণ দেখাইয়া জাতি-তথ্য প্রকাশ করে নাই। দেখা গিয়াএছ মোদির আমলে কংগ্রেস দিনে দিন যত হীনবল হইয়াছে ততই আঁকড়াইয়া ধরিয়াছে জাতিগণনার দাবি। ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে জাতিভিত্তিক দলগুলির মতন রাহুল গান্ধীর স্লোগান শোনা গিয়াছে, জিতনি আবাদি উতনা হক, অর্থাৎ জনসংখ্যানুপাতিক প্রাপ্যের অধিকার। এমতে জাতিগণনা এখন কংগ্রেসের হাতিয়ার। তাহার সারা দেশে প্রচার করিতেছে, তাহাদের চাপেই মোদি সরকার জাতিগণনায় রাজি হইয়াছে। কৃতিত্বের মুখ্য দাবিদার রাহুল গান্ধী।
বাহিরে ডোনাল্ডট্রাম্প বলিতেছেন, ভারত পাক যুদ্ধবিরতির সকল কৃতিত্ব তাহার। সারা রাত ধরিয়া কথা বলিয়া তিনি প্রাত:কালে মেওয়া ফলাইয়াছেন। ট্রাম্পের কথার সার হইলো-বাণিজ্যের প্রস্তাব দিয়াছেন তাই ভারত সিন্দুর বন্ধ রাখিয়াছে। আবার ঘরে জাতিগণনার সরকারী সিদ্ধান্তের কৃতিত্ব দাবি করিতেছেন বিরোধী রাহুল গান্ধী। তাহা হইলে বিজেপি বা প্রধানমন্ত্রী মোদির হাতে কি কেবল হ্যারিকেন? বিজেপির দাবি, কংগ্রেস কোনো দিন যাহা করিতে চাহে নাই, নরেন্দ্র মোদির সরকার তাহা করিয়া দেখাইবার সাহস করিয়াছে। কৃতিত্বের দাবি ও পাল্টা দাবির মধ্যেই যেন আবার ‘যুদ্ধ যুদ্ধ’ আবহ ফিরিয়া আসিতেছে। রাজনৈতিক জল্পনা ও বিতর্কের জন্ম দিয়াছে প্রধানমন্ত্রী মোদির সরকার। অপারেশন সিন্দুরের তুলনা যেন অপারেশন বিহার। স্বাধীন ভারতে প্রথম জনগণনা হয়েছিল ১৯৫১ সালে। সেই থেকে প্রতি ১০বছর অন্তর জনগণনা হয়ে আসছে। ভারতে শেষবার হয় ২০১১ সালে। ২০২১ সালের গণনা স্থগিত হয় কোভিডের কারেণ। ২০২৬ সালে সরকারের ঘোষণা আসিবে, কবে হইবে জনগণনা। দশ বৎসর অন্তর গণনায় সেই হিসাবে পরবর্তী লোকগণনা হইবে ২০৩১ সালে। এর আগে ২০২৯ সালে আসিবে আর একটি লোকসভার নির্বাচন।
বিজেপি যে কোনদিনই জাতিগণনার পক্ষে ছিল না তাহার প্রমাণ মেলে ২০২১ সালেও। মোদি সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিত্যানন্দ রাই লোকসভায় প্রশ্নের জবাবে বলিয়াছিলেন, সরকার সিদ্ধান্ত লইয়াছে তফশিলি জাতি ও উপজাতি ছাড়া জনগণনার সময় জাতিভিত্তিক গণনা হইবে না। সরকারের এই সিদ্ধান্ত নীতিগত। সেই বজেপির সরকার এখন ঢাকঢোল পিটাইয়া জাতিগণনার তুমুল প্রচারে নামিয়াছে কেন? সেই উত্তর জানিতে হইলে বিহারের দিকেই তাকাইতে হইবে। বিহারেই সাম্প্রতিক অতীতে দেশের প্রথম জাতিগণনা হয় মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের তত্ত্বাবধানে। ২০২৩ সালে এই গণনাকালে তখন নীতীশ আরজেডি ও কংগ্রেসের জোটসঙ্গী হইয়া মুখ্যমন্ত্রিত্ব চালাইতেছিলেন। সেই সময় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলিয়াছিলেন, ‘দেশবাসীর মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করিয়া নীতিশের জেডিইউ পাপ করিয়াছে। জাতিগণনা হয় কংগ্রেসশাসিত কর্ণাটক এবং তেলেঙ্গানাতেও। প্রতিবারই প্রবল বিরোধিতা করিয়াছে বিজেপি ও নরেন্দ্র মোদি। এইবার তাহার কন্ঠে ভিন্ন সুর, কারণ তিনি বুঝিতেছে বিহারে ক্ষমতা ধরিয়া রাখিতে হইলে জেডিইউসহ অন্য শরিকগণকে তুষ্ট করিয়া রাখা জরুরি। জেডিইউ, এলজেপি ও হিন্দুস্তানি আওয়ামি মোর্চা (হাম)- তিন দলই জাতিগণনার পক্ষে। কংগ্রেস- আরজেডি- বামপন্থীদের জোটও জাতিগণনার অঙ্গীকার করিয়া বসিয়া আছে। একদিকে ইন্ডিয়া জোটের প্রচার, অন্যদিকে নীতীশ কুমারের ফিকা ভাবমূর্তি বিজেপিকে অসহায় করিয়া তুলে। বিপদ অনুধাবন করিয়া লইয়াছেন মোদি এবং বিজেপি। চলতি বছরের শেষে বিধানসভার ভোটে নীতিশ কুমারকে জিতাইতে এই ঘোষণা যথেষ্ট বলিয়া মনে করিতেছে তারা। তবে আত্মসন্তুষ্টি চরমে নহে। কারণ বিহার জয় ছাড়া মোদির সামনে আর পথ নাই। নীতীশের সমর্থনে দিল্লীতে সরকার টিকিয়া আছে। এ হেন ‘পাল্টুরাম’ যদি বিরোধী ইন্ডিয়া জোটের সমর্থনে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী হইয়া যায় তাহা হইলে নীতীশের সাংসদদের মতিগতি কী হইবে তা বুঝিয়া লওয়া শিবেরও অসাধ্য। অগত্যা তাহাকে খুশি রাখিতেই হইবে। সেই জন্য যে হেতু পয়সা খরচ আপাতত নাই তা হলে ঘোষণায় ক্ষতি কী? অতএব অপারেশন বিহার এই সময় হইতে দেশবাসীর চিন্তা, আবেগ আর ভাবনায় ধীরে ধীরে স্থান করিতে চাহিবে। কেবল সীমান্ত নহে, অভ্যন্তর লইয়াও ভাবিতে হয়।