স্মার্ট মিটারে ফাঁস হচ্ছে দুর্নীতি,তদন্তে গঠিত টাস্কফোর্স, দোষীরা কেউই রেহাই পাবে না: রতন!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-রাজ্য বিদ্যুৎ নিগম কেন কোটি কোটি টাকার লোকসানে চলছে,স্মার্ট মিটার ইস্যুতে তা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আর বিদ্যুৎ নিগমের এই পরিস্থিতির জন্য সম্পূর্ণভাবে দায়ী নিগমের উপর থেকে নীচে পর্যন্ত একাংশ আধিকারিক, অফিসার এবং কর্মীর দুর্নীতি, কর্তব্যে চরম গাফিলতি ও উদাসীনতা। তাদের মনোভাব চুলায় যাক রাজ্যের বিদ্যুৎ পরিষেবা। চুলায় যাক বিদ্যুৎ গ্রাহকদের স্বার্থ। তারা ব্যক্ত শুধু নিজেদের স্বার্থরক্ষায়। দিনভর ঠাণ্ডাঘরে বসে থেকে মাসশেষে মোটা অংকের বেতন পকেটে পুরে নেওয়াই তাদের প্রধান লক্ষ্য।ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। দপ্তর সূত্রে খবর,সাম্প্রতিককালে স্মার্ট মিটার সেই দুর্নীতি কাণ্ডে থাবা বসিয়েছে। শুধু তাই নয়, একাংশ অসাধু গ্রাহক যে বছরের পর বছর ধরে বিদ্যুৎ চুরি করে, মিটার রিডারের সাথে যোগসাজশে বিদ্যুৎ ব্যবহার করে গেছে, স্মার্ট মিটারে সেই সব দুর্নীতি প্রকাশ্যে আসছে। সব থেকে বিস্ময়কর ঘটনা হলো, এসব কাণ্ডকীর্তি চলছে জেনেও এতদিন কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সমস্যার কথা জানা সত্ত্বেও নিগমের আধিকারিকরা (একাংশ) সমস্যা নিরসনে কোনো উদ্যোগ নেয়নি। সব থেকে রহস্যজনক ঘটনা হলো, আচমকা জুলাই মাস থেকে স্মার্ট মিটার নিয়ে গোটা রাজ্যে তোলপাড় শুরু হয়। সরগরম হয়ে উঠে রাজ্য রাজনীতি। বিরোধীরা একজোটে স্মার্ট মিটারের বিরুদ্ধে ময়দানে নামে। অভিযোগ, পরিকল্পিতভাবেই হঠাৎ করে স্মার্ট মিটারের বিরুদ্ধে জনগণকে বিভ্রান্ত করার প্রয়াস শুরু হয়েছে।এর পিছনে গভীর চক্রান্তের বিষয়টিও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। কেননা স্মার্ট মিটার বসানো হলে বিদ্যুৎ বিলে কারচুপি করা আর সম্ভব হবে না। স্মার্ট মিটার নিয়ন্ত্রণ হবে পুরোপুরি বিদ্যুৎ নিগম থেকে। স্মার্ট মিটারে আর মিটার রিডারের প্রয়োজন হবে না। প্রতি মাসের বিদ্যুৎ বিল এখন নিগম থেকে সরাসরি চলে আসবে গ্রাহকের মোবাইল ফোনে। স্মার্ট মিটারে কেউ কোনও কারসাজি করার চেষ্টা করলে, সাথে সাথেই সিগন্যাল চলে যাবে কন্ট্রোল রুমে। ফলে স্মার্ট মিটার অনেকেরই মাথা খারাপ করে দিয়েছে। এদিকে, মিটার জালিয়াতি এবং রাজ্যের কিছু কিছু এলাকায় স্মার্ট মিটারে অস্বাভাবিক বিল আসা নিয়ে গোটা রাজ্য জুড়ে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন বিদ্যুৎমন্ত্রী রতনলাল নাথ।এই বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দিয়ে বিদ্যুৎমন্ত্রী শ্রী নাথ বলেন, দোষীদের একজনও রেহাই পাবে না। এতদিন ধরে বিদ্যুৎ বিলে নিগমের যে রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে, তা অভিযুক্তদের কাছ থেকে আদায় করা হবে। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
স্মার্ট মিটার ইস্যুতে মন্ত্রীর নির্দেশে বিদ্যুৎ নিগম আজই চার সদস্যের একটি তদন্ত টিম অর্থাৎ টাক্সফোর্স গঠন করেছে। এই চার জন সদস্য হলেন, শিশির দেববর্মা (ডিজিএম), রাজীব কুমার রায় (ডিজিএম), সঞ্জীব নন্দী মজুমদার (সিনিয়র ম্যানেজার) এবং জহর দেববর্মা (সিনিয়র ম্যানেজার)। এই টিম সারা রাজ্যে মিটার এবং স্মার্ট মিটার সংক্রান্ত যাবতীয় ইস্যু এবং সমস্যার তদন্ত করবে। সাথে সাথে সমস্যা নিরসনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। বিদ্যুৎ নিগম থেকে দুটি হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর দেওয়া হয়েছে। নম্বর দুটি হলো ৬০৩৩১৩১৯৬৬ এবং ৬৯০৯৯৮১২৭৪। এই দুটি নম্বরে শুধু স্মার্ট মিটার সংক্রান্ত কোনো বিষয়ে সমস্যা, অভিযোগ বা কোনো তথ্য জানতে চাইলে মেসেজ পাঠাতে হবে। টাস্কফোর্স টিম সেই মেসেজ অনুযায়ী সাথে সাথে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে অথবা মেসেজের জবাব দেবে।
মন্ত্রী জানিয়েছেন,ইতিমধ্যে কয়েকটি জায়গা থেকে অভিযোগ পেয়ে তদন্ত করার পর দুর্নীতির বিষয়টি উঠে আসে। মিটার রিডার এবং অসাধু গ্রাহক যোগসাজশে রিডিং কম দেখিয়ে কারচুপি করে যাচ্ছিল। এমনই একটি ঘটনা প্রকাশ্যে আসে খোয়াই লালছড়া থেকে। মন্ত্রী জানান, লালছড়ার বাসিন্দা অশোক কান্তি দাস রায়ের বাড়িতে ২০২১ সাল থেকে মিটার রিডার বিদ্যুৎ মিটার নষ্ট বলে উল্লেখ করে একটি মনগড়া ইউনিট সংখ্যা লিখে বিল করে যাচ্ছিল। ২০২১ সাল থেকে কান্তিবাবু ২০২৫ সালের ২৫ জুন পর্যন্ত যত পরিমাণ বিদ্যুৎ ব্যবহার করেছেন, তিনি বিল দিয়েছেন মিটার বন্ধ বা নষ্ট হওয়ার আগের তিন মাসে দেওয়া বিলের গড় হিসাব অনুযায়ী। গত ২৫ জুন ২০২৫ ইং কান্তিবাবুর বাড়িতে স্মার্ট মিটার বসানো হয়। স্মার্ট মিটার যখন বসানো হয় তখন কান্তিবাবুর পুরনো মিটার, যে মিটারকে নষ্ট বলে উল্লেখ করে মিটার রিডার কম টাকার বিল দিয়ে যাচ্ছিল সেই মিটারে রিডিং ছিলো ১১,১৪৮। কান্তিবাবু মিটার পরিবর্তন করার সময় উল্লেখিত এই মিটার রিডিংয়ে কাগজে স্বাক্ষর করেন। এটাই নিয়ম। বিদ্যুৎ কর্মীরা যখন নতুন স্মার্ট মিটার বসান, তখন স্মার্ট মিটারের রিডিং শূন্য করে তবেই বসিয়েছে। কান্তিবাবু সেই কাগজেও স্বাক্ষর করেছেন। এবার জুলাই মাসে যখন কান্তিবাবুর কাছে নিগম থেকে বিল আসে তখন গত চার বছরের বকেয়া সহ এক সাথে ৮২,৫৮৯ টাকা বিল আসে। এই বিল আসার পরই টনক নড়ে সকলের।
এই ঘটনার পরই মন্ত্রীর নির্দেশে বেসরকারী বিলিং এজেন্সিকে শোকজ করা হয়েছে সাতদিনের সময় দিয়ে। শুধু এই ঘটনাই নয়, ধর্মনগরের ভাগ্যপুর গ্রামে গৌরাঙ্গ নাগ নামে এক দিনমজুরের বাড়িতে স্মার্ট মিটার বসানোর পর তিন মাসে বিদ্যুৎ বিল আসে ১২ লক্ষ ২০ হাজার ৪৮৫ টাকা। বিস্ময়কর ঘটনা হলো, দিনমজুর গৌরাঙ্গ নাগের বাড়িতে চলতি বছরের মার্চ মাসে স্মার্ট মিটার বসানো হয়েছিল। এরপর প্রথম বিল আসে ১১ লক্ষ ৫১ হাজার ৫৫৬ টাকা। এই বিল পেয়েই গৌরাঙ্গবাবু ছুটে গিয়েছিলেন ধর্মনগর বিদ্যুৎ নিগম অফিসে। বিষয়টি তিনি জানিয়েছেন। কিন্তু কেউ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। পরের মাসে বিল আসে ১১ লক্ষ ৭৪ হাজার ৩৫০ টাকা। এবারও দপ্তরকে জানান। ব্যবস্থা নিচ্ছি বলে ঘুমিয়ে থাকে নিগম। তৃতীয় মাসে অর্থাৎ জুলাই মাসে বিল আসে ১২ লক্ষ ২০ হাজার ৪৮৫ টাকা। এবার গৌরাঙ্গবাবু সংবাদ মাধ্যমের দ্বারস্থ হন। বিষয়টি বিদ্যুৎমন্ত্রীর নজরেও আসে। মন্ত্রীর দাবড়ানি খেয়ে বারো লক্ষের বিল ঘন্টাখানেকের মধ্যে মাত্র ১৪০০ টাকায় নেমে আসে। কিন্তু কেন এমন অস্বাভাবিক বিল এলো, তা তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন মন্ত্রী।
এদিকে মন্ত্রী জানান, রাজ্যে স্মার্ট মিটার বসানোর কাজ শুরু হয়েছে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর থেকে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে স্মার্ট মিটারে বিল হয়েছে ৫৬৮৭টি, ২০২৫-এর জানুয়ারীতে বিল হয়েছে ১৮৬৫টি, ফেব্রুয়ারী মাসে বিল হয়েছে ৬১৫০টি, মার্চ মাসে বিল হয়েছে ১৯,৯৩০টি, এপ্রিল মাসে বিল হয়েছে ৪৩,৬১১টি, মে মাসে বিল জেনারেট হয়েছে ৫৮,০৪৮টি, জুন মাসে বিল জেনারেট হয়েছে ৭৩,৫৯৩টি এবং জুলাই মাসে বিল জেনারেট হয়েছে ৭৯,৬৫৩টি।
মন্ত্রী বলেন, ২০২৪-এর ডিসেম্বর থেকে স্মার্ট মিটারে বিল জেনারেট হয়ে আসছে, কোনো অভিযোগ নেই। রহস্যজনক ঘটনা হলো, জুলাই মাস থেকে আচমকা স্মার্ট মিটার নিয়ে শোরগোল শুরু হয়।এটি উদ্দেশ্যমূলক একটি চক্রান্ত বলে মন্ত্রী দাবি করেন। মন্ত্রী বলেন, স্মার্ট মিটার বিজ্ঞানসম্মত অত্যাধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর। কারচুপি করা সম্ভব নয় বলেই কি এত হৈ চৈ করা হচ্ছে? প্রশ্ন তুলেন বিদ্যুৎমন্ত্রী। আজও তিনি গ্রাহকদের আশ্বস্ত করেন, স্মার্ট মিটার সুরক্ষিত। এতে বেশি বিল আসার কোনো সম্ভাবনা নেই। যদি কোনো সমস্যা দেখা যায়, তার জন্য দপ্তর এবং বিদ্যুৎ নিগম রয়েছে সমস্যা সমাধানের জন্য।