সিঁদুর-মাহাত্ম্য!!

 সিঁদুর-মাহাত্ম্য!!
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

ভারতীয় সেনাবাহিনীর ‘অপারেশন সিন্দুর’-এর পরে বঙ্গের মাটিতে প্রথম জনসভা থেকে বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ‘সিঁদুর’-এর শক্তির ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সন্ত্রাসবাদীরা আমাদের বোনেদের সিঁদুর মুছে দেওয়ার স্পর্ধা দেখিয়েছিল। আমাদের সেনারা সিঁদুরের শক্তি দেখিয়ে দিয়েছে। প্রসঙ্গত, হিন্দু এয়োতিদের মধ্যে ভারতের পূর্ব প্রান্তে সিঁদুরের প্রচলন বেশি, তুলনায় পশ্চিম এবং উত্তর ভারতে কম। প্রধানমন্ত্রীর মুখনিঃসৃত এই বাক্যের ব্যাঞ্জনা দ্বিবিধ। প্রথমত, তিনি বার্তা দিয়েছেন যে, অপারেশন সিন্দুরের যুবনিকাপাত হয়নি, সেটি এখনও চলমান একটি প্রক্রিয়া। দ্বিতীয়ত, সিঁদুর নামক আপাত-নিরীহ লাল রঙের গুঁড়া বস্তুটির শক্তি অপার। এর আগেও তার নিজের রাজ্য গুজরাটের মাটিতে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সন্ত্রাসবাদীরা ভারতের কন্যা, বোনদের মাথার সিঁদুর মুছে দিয়েছিল। তাই ভারতের সেনা পাকিস্তানের ভেতরে ঢুকে সন্ত্রাসবাদীদের সদর দপ্তরে হামলা চালিয়েছে। যুদ্ধের বাজনা বাজিয়ে রাখা এবং সিঁদুরের শক্তি, সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি বিষয়কে এক বন্ধনীতে দেখতে হলে কিঞ্চিৎ বিশ্লেষণ জরুরি। আগামী এক বছরের মধ্যে এমন তিনটি বড় রাজ্যে বিধানসভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা, যে তিন রাজ্যে হিন্দু সধবা নারীদের মধ্যে সিঁদুর একটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর বস্তু, অধিকন্তু তাদের অস্তিত্বের সঙ্গে সমার্থক। এই তিন রাজ্য যথাক্রমে বিহার, আসাম এবং পশ্চিমবঙ্গ। এর মধ্যে কোনো ভুল নেই ‘অপারেশন সিন্দুর’ নরেন্দ্র মোদির মহিলা ভোটব্যাঙ্ক আরও সুসংহত করবে। এর সুফল তিনি বিহারের বিধানসভা নির্বাচনে পাবেন, সে সম্ভাবনাই অধিক। হয়তো এরপরে বাংলা, আসাম ছাড়াও আগামী বছর অনুষ্ঠিতব্য কেরল এবং তামিলনাড়ুর বিধানসভা নির্বাচনেও সিঁদুরের কল্যাণে মা-বোনেদের ভোটের একটা বড় অংশ পদ্মের ঝুলিতে পড়তে পারে।
পহেলগাঁওয়ে পর্যটকদের উপরে সন্ত্রাসবাদী হামলার দিন চারেক আগে প্রবাসী পাকিস্তানিদের সম্মেলনে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক আসিম মুনির ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’ শুনিয়েছিলেন।মুনিরের বক্তব্য ছিল, পাকিস্তানের ছেলেমেয়েদের দেশের সৃষ্টির কাহিনি শোনাতে হবে। পাকিস্তান তৈরির কাহিনি কোনওভাবেই ভুলতে দেওয়া চলবে না। মনে রাখতে হবে, পাকিস্তানের আদিপুরুষরা বুঝেছিলেন যে মুসলিমরা হিন্দুদের থেকে সবরকমভাবে আলাদা। মুনিরের যুক্তি ছিল, আমাদের ধর্ম আলাদা। প্রথা আলাদা। ঐতিহ্য আলাদা। চিন্তাভাবনা আলাদা। লক্ষ্য আলাদা। সেখানেই দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত। আমরা দুটি আলাদা রাষ্ট্র। এক নই। এই শব্দগুলি গত এক দশকের ভারতের কাছে কোনও আলটপকা, অযোনিসম্ভূত শব্দ নয়। উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা এই কথাগুলিই উল্টোদিক থেকে বলছেন। ভারত হিন্দুদের দেশ। মুসলিম হলে পাকিস্তানে চলে যাওয়াই শ্রেয়। এই উগ্র হিন্দুত্ববাদের আঁচে গেরুয়া শিবির ও বিরোধী শিবির, দুই পক্ষই নিজেদের সুবিধামতো রাজনীতির রুটি সেঁকার চেষ্টা করে চলেছে। এর প্রভাবে দেশের একটা বড় অংশ এখন বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন, ভারতের কুড়ি, মতান্তরে বাইশ কোটির মতো মুসলিম বিদায় নিলেই দেশের অনেক সমস্যা মিটে যাবে। চাকরিবাকরি পেতে, ভালো স্কুলে ভর্তি হতে, সরকারী হাসপাতালে চিকিৎসা পেতে বাধা থাকবে না। সর্বোপরি হিন্দুদের মাথায় উপর যে বিপদের খাঁড়াটি ঝুলছে, সেই বিপদ কেটে যাবে। এই আলেখ্য বলে, মুসলিম মানেই জেহাদি, কাশ্মীরি মানেই বিচ্ছিন্নতাবাদী আর প্রকৃত হিন্দু সে-ই, যার মুসলিম বা কাশ্মীরিদের প্রতি কোনো সহানুভূতি নেই।
বিভাজনের বিষ যে সমাজের কতখানি গভীরে প্রোথিত হয়েছে, পহেলগাঁওয়ে নিহত নৌসেনার লেফটেন্যান্ট বিনয় নারওয়ালের স্ত্রী হিমাংশী তারই একখণ্ড নির্লজ্জ সাম্প্রতিক উদাহরণ। বিবাহের ছয় দিনের মাথায় বুলেটে বিদ্ধ রক্তাক্ত স্বামীকে চোখের সামনে মরতে দেখা হিমাংশীকে সমাজমাধ্যমে কদর্য ভাষায় আক্রমণের মুখে পড়তে হয়েছিল, কারণ হরিয়ানার কর্নালে স্বামীর শেষকৃত্যের দিন সংবাদমাধ্যমের সামনে পেশায় গবেষিকা এই তরুণীর আর্জি ছিল, পহেলগাঁও হামলার জন্য সব মুসলমান বা কাশ্মীরি জনগণকে যেন দায়ী করা না হয়।হিমাংশীর জন্য সহানুভূতি রাতারাতি হিংস্র আক্রমণে বদলে যায়। সমাজমাধ্যমে তাকে প্রবল বিদ্রূপের মুখে পড়তে হয়। তাকে এমন ভাষা-সংহার হজম করতে হয়েছে যে, তুমি প্রকৃত হিন্দু হলে তোমার মনে মুসলিমদের প্রতি সহানুভূতি থাকতে পারে না, শুধুই উগ্র হিন্দু, একটাই পরিচয়।
অতএব রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে নরেন্দ্র মোদির আসল চ্যালেঞ্জ হয়তো এখানেই। দেশের রাষ্ট্রনায়ক হিসাবে, দল যাকে বিশ্বগুরু হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে, তার আসল পরীক্ষা, আসিম মুনিরের হাত ধরে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতেও যাতে নতুন করে দ্বিজাতি তত্ত্বের বিষ শিকড় ছড়াতে না পারে, তা নিশ্চিত করা।বিজেপি শীর্ষনেতৃত্ব কি সেই চেষ্টা করবেন,না কি সিঁদুর-মাহাত্ম্য বর্ণনা করে ভোটের ময়দানে বিভাজনের রাজনীতি আঁকড়ে ধরবেন, সেটা তারাই জানেন।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.