শক্তি সংরক্ষণে ফের রাষ্ট্রপতি পুরস্কারে ভূষিত হলো ত্রিপুরা!!
সাংস্কৃতিক আগ্রাসন!!
বাংলাদেশে জুলাইয়ের তথাকথিত রাষ্ট্রবিপ্লব দক্ষিণপন্থী কট্টর ইসলামিক গোষ্ঠীগুলির মৌলবাদী তৎপরতাকে কি আইনগত স্বীকৃতি দিতে চাইছে? এই প্রশ্ন উঠেছে সে দেশের নাগরিকদের মধ্যেই। বাউল পালাকার আবুল সরকারকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে গ্রেপ্তারের ঘটনা সেই ইঙ্গিতই দেয়। আবুল সরকারকে গ্রেপ্তারের পর তার অনুসারীরাও হামলার শিকার হচ্ছেন। তার গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে মানববন্ধন করতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন বাউল ও বাউল সমর্থকেরা। পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছেন কেউ কেউ। সেই দৃশ্য দেখেছে বিশ্ববাসী। শেখ হাসিনা সরকার উচ্ছেদের পর সেই দেশটিতে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা চরম আকার নেয়। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও অন্য ধর্মের লোকেদের ওপর চরম আক্রমণ নামিয়ে আনা হয়। হিন্দুদের মন্দিরগুলির সঙ্গে ভাঙা শুরু হয় বাউল, ফকিরদের মাজারগুলি।আন্তর্জাতিক চাপে মন্দির ভাঙায় ভাটা পড়লেও মাজার ভাঙতে ডজার নেমে আসছে। প্রাচীন গাছও কেটে ফেলা হচ্ছে কোথাও কোথাও। হালে শুরু হয়েছিল আউল বাউল, ফকির পাগলদের ধরে চুল, দাড়ি কেটে দেওয়া। জনমতের চাপে এক সময় মৌলবাদীরা এইগুলি বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। ঘটনা হল মাজার ভাঙা বা বাউলদের ওপর হামলার প্রতিবাদ জানাতে এগিয়ে আসবে না বিশ্ব জনমত। কারণ এই সংস্কৃতি একান্তই বাংলার নিজস্ব। ফকিরি আর সুফিবাদ বহিরঙ্গে অনেকটা কাছাকাছি হলেও বিষয়টি তাত্ত্বিকভাবে এক নয়। তবে একই পন্থার। কোরান, পুরাণকে ঘৃণা করে সহজের পথের উপাসনা বা আধ্যাত্মিকতার এই পথ শুরু থেকে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের চক্ষের বিষ। মোল্লাবাদ বা ব্রাহ্মণ্যবাদ দুই দিক থেকেই তারা আক্রান্ত হয়ে থাকেন।
তথাপিও অধুনা বাংলাদেশের লালন যিনি বৃহৎ, বাংলায় রবীন্দ্রনাথকেও প্রভাবিত করে ছেড়েছিলেন। তার গীত তার ভাবনা বিশ্ববাঙালির জন্য এক অহঙ্কার। এমনই বলা হয়ে থাকে, ভাবা হয়ে থাকে। বাংলার বাইরে, বাংলাদেশের বাইরে বিশ্বের নানান প্রান্তের যেসব শুভাকাঙ্ক্ষী বাউলসমাজের খোঁজখবর রাখেন কিংবা নানান উৎসবে বাউলদের দেখা পান তারা হয়তো ভাবতে পারেন বাংলাদেশের বাউলসমাজ খুবই সম্মানের সঙ্গে দিন কাটাচ্ছে।তাদের এই ভাবনার পেছনে রাষ্ট্রের বিজ্ঞাপনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। ঢাকায় পয়লা বৈশাখে আনন্দ শোভাযাত্রার প্রথম সারিতে শত শত বাউলের উপস্থিতি কিংবা লালনের তিরোধানে দেশ-বিদেশ থেকে সাব-অল্টার্ন তাত্ত্বিকদের ডেকে এনে উদ্যাপন বাংলাদেশে বাউলদের প্রতি সম্মানের বার্তাই বহন করে।
বিজ্ঞাপন আর বাস্তবতা খুবই আলাদা বিষয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপনের সঙ্গে বাস্তবতার মিল কমই থাকে। বাংলাদেশের বাউল-ফকির, সন্ন্যাসীদের নিয়ে রাষ্ট্রের যে প্রদর্শন, প্রখর বাস্তবতা তার চেয়ে শুধু ভিন্ন নয়, বরং উল্টো। নিরাপত্তা দেওয়ার অজুহাতে পালাগানের আসর থেকে তুলে নিয়ে আসা হয় আবুল সরকারকে। পুলিশ এর পরেই তার বিরুদ্ধে ধর্মা অবমাননার অভিযোগে দিয়ে কারাগারে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। কেন? কট্টরপন্থী মৌলবাদীদের অভিযোগ ছিল পালাগানে গান গেয়ে ইসলাম অবমাননা করছেন। গানের কথা ধর্ম অবমাননাকারী ছিল। তারা এই ধরনের অভিযোগ আনবে এটা খুব স্বাভাবিক বিষয়।কিন্তু রাষ্ট্র এই অভিযোগের তদন্ত না করে তাকে কারাগারে কীভাবে নেয়?রাষ্ট্র কি সেই কট্টরপন্থীদের অবস্থানকে আইনি স্বীকৃতি দিচ্ছে? গত বছরে জুলাইয়ের পর বাঙলাদেশের কথা উঠেছিল ন্যাশনাল হেরিটেজ প্রোটেকশন অ্যাক্ট’-এর। যেই অ্যাক্ট বা আইনের মাধ্যমে সুরক্ষা দেওয়া যাবে এই জনজাতির মৌলিক চিন্তার পাঠশালা-বাউল-ফকির-সাধকদের আখড়া, মঠ, মাজারগুলোকে। শত শত বছর ধরে যে জনপ্রতিষ্ঠানগুলোই বাংলার সামগ্রিক চিন্তা কাঠামোর বিকাশ ঘটিয়েছে, পথ দেখিয়েছে। সেই প্রতিষ্ঠানগুলিকে সুরক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত বাউল, ফকির-সন্ন্যাসীদের সুরক্ষাও সম্ভব হবে। বলা বাহুল্য, সেই ধরনের কোনও উদ্যোগ ইউনুসের সরকার নেয়নি। অবশ্য কেবল আইন করেও বাউল ফকির সন্ন্যাসীদের বাঁচানো সম্ভব নয়।ডানপন্থীদের প্রবল জৌলুসের এই মরশুমে তো’নয়ই। তবু দেশে কোনও আইন যদি থাকতো তাহলে অনেক ইচ্ছুক নাগরিক বা সমষ্টি নিপীড়িতের পাশে দাঁড়াতে পারতেন। বাংলাদেশের বৃহৎ সাংস্কৃতিক বলয়ে সুফিসাধক-বাউল-ফকিরদের চেয়ে বেশি নিপীড়িত এই মুহুর্তে আর কেউই নয়। হামলা, মামলা- কোনো নিপীড়ন থেকেই রেহাই নেই মরমি সাধকদের। এমন বাস্তবতায় রাষ্ট্র নিজেই যদি তাদের সুরক্ষা দিতে পাশে না দাঁড়ায়, তাহলে দাঁড়াবে কে? হামলা না হয়জনতাই প্রতিরোধ করবে, কিন্তু হয়রানিমূলক মামলা থেকে সুরক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব তো রাষ্ট্রের।
গত ২১ নভেম্বর আবুল সরকারের গ্রেপ্তারও গ্রেপ্তারির পর প্রতিবাদকারীদের ওপর হামলা বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের একটি ভয়াবহ বার্তা। বাউলদের ভয় দেখানো মানে বাংলার মরমি সাধনা, তার চেতনাকে ভয় দেখানো। যদিও ইতিহাস বলে সংস্কৃতি কখনও দমন মানে না। আবুল সরকারের গ্রেপ্তার শুধু একজন শিল্পীর বিরুদ্ধে মামলা নয়, এটি অন্য কিছুর আহ্বান যা রাষ্ট্রশক্তিকে চরম বেকায়দায় ফেলবে। রাষ্ট্র বহুত্ববাদী সংস্কৃতিকে রক্ষা করবে, নাকি ‘প্রেশার গ্রুপ’ চাপে মানবতার গান গাওয়া বাউলদের গলা টিপে ধরবে- সে সিদ্ধান্তই সেই রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।