অন্ধ্রপ্রদেশের মন্দিরে একাদশীর ভিড়ে পদপিষ্ট, মৃত অন্তত সাত!শোকপ্রকাশ মুখ্যমন্ত্রীর!!
সর্বনাশা নেশা!!
‘সর্বনাশের নেশা’ কথাটির আভিধানিক অর্থ,সর্বনাশ করাই যার নেশা। কিন্তু ‘সর্বনাশা নেশা’র অর্থ এমন নেশা যা সর্বনাশ ডেকে আনে।শৈশবে বিদ্যালয়ে শিক্ষকেরা পরামর্শ দিতেন, ‘তাস, দাবা পাশা/তিন সর্বনাশা’।কৈশোরে শিক্ষকেরা বলতেন, ‘ধূমপানের নেশা সর্বনাশা’। কিন্তু এখন সে সব ছাপিয়ে গেছে ‘রিলের নেশা’।
আজকের পৃথিবীতে আঙুলের ডগাতেই বিনোদনের রাজত্ব।টেলিভিশন, সিনেমা, সংবাদপত্র, সবকিছুকে পিছনে ফেলে দিয়েছে সমাজমাধ্যম। আর এই সমাজমাধ্যমে এখন একটাই রাজা রিল (মতান্তরে ‘রিলস’)। স্ক্রল থামছে না, সময়ের হিসাব মিলছে না। ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যাচ্ছে ইনস্টাগ্রাম বা ফেসবুকের পর্দায়। অফিসে, বাসে, বিছানায়- সর্বত্রই চলছে রিল দেখার নেশা। এ যেন নতুন যুগের মাদক। আঙুল চলছে, চোখ স্থির। আর মস্তিষ্ক? ধীরে ধীরে বন্দি হয়ে যাচ্ছে এক ভার্চুয়াল ঘূর্ণির মধ্যে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যখন আপনি মাথা সোজা রাখেন, তখন আপনার মাথার ওজন (প্রায় ৪.৫ থেকে ৫ কেজি) সুষমভাবে মেরুদণ্ডে ভাগ হয়ে পড়ে। কিন্তু মোবাইলের দিকে তাকিয়ে ঘাড় ত্রিশ থেকে ষাট ডিগ্রি নিচু করলেই মেরুদণ্ডের উপর চাপ বেড়ে যায় প্রায় কুড়ি থেকে পঁচিশ কেজি পর্যন্ত; অর্থাৎ চার গুণ বেশি! তবু এই সর্বনাশা নেশার খামতি নেই।
চিনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রকাশ, রিল আসক্তি মস্তিষ্কে এমন প্রভাব ফেলে যা অ্যালকোহল বা জুয়ার আসক্তির সমতুল্য। ডোপামিনের অতিরিক্ত স্রোত মানুষকে বাস্তব থেকে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। রিলের সংক্ষিপ্ত উত্তেজনা, দ্রুত আনন্দের প্রাপ্তি, আর বারবার নতুন কিছু দেখার আকাঙ্ক্ষা এগুলো মিলেই তৈরি করছে এক ভয়ানক মানসিক নির্ভরতা।এর ফল, মনোযোগের ঘাটতি, উদ্বেগ, বিষন্নতা, এমনকী বাস্তব জীবনের সম্পর্কেও উদাসীনতা বাড়তে পারে।
রিলের জগৎকে অনেকে বলছেন নতুন যুগের ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লব’। এখানে বিনোদন, শিক্ষা, তথ্য- সবই আছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই বিপ্লবটা ঠিক কোন পথে যাচ্ছে? কারণ, এই মুহূর্তে সমাজমাধ্যমে যে রিলের স্রোত বইছে, তার বড় অংশই রুচিহীন, অশ্লীল বা নকল সংস্কৃতির বাহক। কোনো নৈতিক সীমা নেই, কোনো সামাজিক দায় নেই যেন যা খুশি তাই। গ্রামে ধান খেতে বা শহরের রাস্তায় দাঁড়িয়ে কেউ উদ্দাম নাচছেন, কেউ রাতের পোশাকে ক্যামেরার সামনে। যেন নিজের দেহটাই হয়ে উঠছে ‘কনটেন্ট’।
এদেশেও ইতিমধ্যে একাধিক কনটেন্ট ক্রিয়েটরের বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযোগ উঠেছে।কেউ বলছেন, এটাই তাদের বাঁচার পথ-‘একটা ফোন, একটা ইন্টারনেট কানেকশন, আর সাহস থাকলেই রোজগার’। বাস্তবও সেটাই। দেশে বেকারত্ব বাড়ছে, সুযোগ কমছে, তাই অনেকেই শর্টকাট পথে ‘খ্যাতি’ আর ‘আয়’-এর সন্ধানে নেমেছেন। কিন্তু এই প্রবণতা সমাজকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? আজ পরিশ্রম নয়, শর্টকাট সাফল্যই নতুন মন্ত্র। বিদ্যা, মেধা, পরিশ্রম- এগুলি যেন এখন কেবল বইয়ের পাতায় রয়ে গেছে। অন্যদিকে, রিলের প্রভাব পড়ছে কিশোর মনেও। ভারতে নাবালক ব্যবহারকারীর সংখ্যা কয়েক কোটি। তারা যখন হিংসা, যৌনতা বা কৃত্রিম বিলাসিতার ভিডিও বারবার দেখে, তখন সেই দৃশ্যগুলোই হয়ে উঠছে তাদের বাস্তবের ধারণা।বিদেশে এর পরিণতি নিয়ে ভয়াবহ অভিজ্ঞতা দেখা গেছে। তাই অস্ট্রেলিয়া ইতিমধ্যেই ষোলো বছরের নিচে সমাজমাধ্যম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু ভারতে এখনও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেই।
ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামের নিয়ন্ত্রক সংস্থা মেটা দাবি করে, তাদের ‘কমিউনিটি স্টান্ডার্ড’ আপত্তিকর কনটেন্ট সরিয়ে দেয়। কিন্তু বাস্তব ছবিটা ভয়াবহ। আপত্তিকর ভিডিও ঝাপসা করা বা সতর্কবার্তা দেওয়ার নিয়ম কাগজে আছে, কিন্তু প্রয়োগে নেই। বরং দেখা যাচ্ছে, অ্যালগরিদম ইচ্ছাকৃতভাবে এমন কনটেন্টকেই বেশি ‘রিচ’ দিচ্ছে যাতে বাড়ে ভিউ, বাড়ে বিজ্ঞাপন আয়ে। অর্থাৎ বহুজাতিক সংস্থার মুনাফার লোভেই সমাজের মানসিক অবক্ষয় ঘটছে। এখন প্রশ্ন, সরকার কি নীরব দর্শক হয়ে থাকবে? আর আমরা যারা প্রতিদিন আঙুল চালিয়ে এই ভিডিও দেখি- তাদেরও কি কোনো দায় নেই? যখন শিশুরা পর্দার আড়ালে বড় হয়ে উঠছে এক বিকৃত সংস্কৃতির মধ্যে, তখন কি আমাদের ভূমিকা শুধু ‘লাইক’ আর ‘শেয়ার’-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে?
সময় এসেছে কড়া ছাঁকনির। শুধু আইন নয়- প্রয়োজন সামাজিক জাগরণ, পরিবারে কথোপকথন, স্কুলে ডিজিটাল শিক্ষার সঠিক দিশা, রিল সংস্কৃতি বন্ধ করা নয়, তাকে সংযত করা, সৃজনশীলতার পথে ফিরিয়ে আনা – সেটাই এখন সবচেয়ে জরুরি। না হলে, এই ‘রিল তরঙ্গ’ একদিন বাস্তব সমাজকেই ভাসিয়ে নিয়ে যাবে এমন এক অন্ধ স্রোতে, যেখানে কনটেন্ট নয়, বিকৃতি-ই হবে প্রধান সংস্কৃতি। আর আমরা, পর্দার ওপারে দাঁড়িয়ে দেখব, কীভাবে মানুষ ধীরে ধীরে মানুষত্ব হারাচ্ছে!