সরকারী স্কুলে ক্ষয়রোগ!!

দেশের সমস্ত ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা যাতে স্কুলের গণ্ডীতে আসতে পারে, একজন শিশুও যাতে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে দেশের প্রায় সর্বত্রই স্কুলে পড়ুয়াদের মধ্যে মধ্যাহ্নের আহার বা মিড-ডে মিল চালু আছে। বেশকিছু রাজ্য আছে যেখানে স্কুলপড়ুয়াদের বিনামূল্যে পোশাকও দেওয়া হয়। আবার কোথাও সাইকেলও বিলি করা হয় ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে। উদ্দেশ্য একটাই, যাতে স্কুলছুটের সংখ্যা কমানো যায় এবং শিক্ষার অগ্রগতি সর্বত্র সমানভাবে বিকশিত হতে পারে। কিন্তু তারপরেও দেশে দ্রুতহারে স্কুলে ভর্তি হওয়া ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে।
কেন্দ্রীয় সরকারের সাম্প্রতিক প্রকাশিত একটি রিপোর্টে দেখা গেছে, ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে দেশে পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীর সংখ্য ছিল ২৫ কোটি ১৮ লক্ষ। পরের বছর ২০২৩-২৪ সালে এই সংখ্যাটা কমে দাঁড়িয়েছে ২৪.৮০ কোটি। এর পরের বছর ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে সেটা আরও নেমে দাঁড়িয়েছে ২৪.৬৯ কোটি। অর্থাৎ এক বছরের মধ্যে দেশে পড়ুয়ার সংখ্যা কমে গেছে ১১ লাখ। আর ২০২২ থেকে ২০২৫ পর্যন্ত স্কুলগুলোতে পড়ুয়ার সংখ্যা কমেছে ৫০ লক্ষ। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রদত্ত রিপোর্টে যে বিব্রতকর প্রবণতা ধরা পড়েছে, সেটা এখানেই থেমে নেই। চাঞ্চল্যের আরও বড় ঘটনা হলো, কেন্দ্রের রিপোর্ট বলছে দেশে সরকারী স্কুলে ক্রমশ কমছে শিক্ষার্থীর সংখ্যা। অন্যদিকে, পাল্লা দিয়ে পড়ুয়ার সংখ্যা বাড়ছে বেসরকারী স্কুলগুলোতে। এই ঘটনা শুধু উদ্বেগজনকই নয়, রীতিমত চিন্তার জগতকে নাড়া দিয়ে গেছে। গোটা দেশের পরিসংখ্যান তুলে বিব্রতকর পরিস্থিতি না বাড়িয়েও বলা যায়, দেশের ৩টি রাজ্য তেলেঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশ আর উত্তরাখণ্ড- এই তিন রাজ্যে বেসরকারী স্কুলের শিক্ষার দৌড়ের কাছে একরকম হামাগুড়ি দিচ্ছে সরকারী শিক্ষা ব্যবস্থা। কেন্দ্রের রিপোর্টই বলছে অন্ধ্রপ্রদেশে সরকারী স্কুলের সংখ্যা ৪৫ হাজার, আর বেসরকারী স্কুলের সংখ্যা ১৫ হাজার ২৬২টি। অথচ রাজ্যটিতে সরকারী স্কুলে পড়ুয়ার সংখ্যা ৪৬ শতাংশ, আর বেসরকারী স্কুলে পড়াশোনা করছে ৫২ শতাংশ। একই চিত্র উত্তরাখণ্ড এবং তেলেঙ্গানায়।
প্রশ্ন হলো, শিক্ষার কেন এই অন্তর্জলি যাত্রা! আসলে শুধু কেন্দ্রীয় সরকারের এই রিপোর্টই কেন, বহু বছর আগে থেকেই শুরু হয়েছিল সরকারী শিক্ষায় এই অচলায়তন। দেশের সব রাজ্যেই সরকারী শিক্ষা ব্যবস্থার এই বেহাল দশা। যা এতদিন লোকের মুখে মুখে প্রচার হতো, সেটাই এবার কেন্দ্রীয় রিপোর্টে স্বীকৃতি পেলো। শিক্ষামন্ত্রক এ কথাও বলেছে, এবারের রিপোর্ট পূর্ববর্তী বছরগুলোর তুলনায় অনেকটাই নির্ভুল এবং ভিন্ন। কারণ এবার আধার নম্বর মিলিয়ে পড়ুয়াদের তথ্য সংরক্ষণ করা হয়েছে। কিন্তু স্বাভাবিক কারণেই যে প্রশ্নটা সামনে আসছে তা হলো, কেন এই ব্যর্থতা? ঘটনা হচ্ছে, এবারের রিপোর্ট তৈরি করেছে ইউনিফায়েড ডিস্ট্রিক্ট ইনফরমেশন সিস্টেম ফর এডুকেশন প্লাস। যেহেতু এটি একটি কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রকের অধীন সংস্থা, তাই এই সমীক্ষাকে কোনোভাবেই এলেবেলে রিপোর্ট মনে করে ছুড়ে ফেলে দেওয়ার সুযোগ নেই। তাই এই রিপোর্টকে গুরুত্ব দিয়ে দেখার পাশাপাশি এর ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুটো দিকই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখা দরকার। প্রথম কথা দেশে জন্মহার কমছে। দক্ষিণ ভারত হচ্ছে এর বড় দৃষ্টান্ত। দেশে বর্তমানে বিহার, উত্তরপ্রদেশ ও মেঘালয় ছাড়া সব রাজ্যেই জন্মহার হ্রাস পেয়েছে। সুতরাং স্কুলে ভর্তির খাতায় নাম লেখানোর মতো শিশুর জন্মও কম হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু তাই বলে, সরকারী স্কুলের তুলনায় বেসরকারী স্কুলে ছাত্র ভর্তির হার বৃদ্ধির প্রবণতা সরকারী ব্যর্থতাকেই চোখে আঙুল তুলে দেখিয়ে দিচ্ছে। এবার আসা যাক কোথায় ব্যর্থতা। সমীক্ষায় বলা আছে, দেশে বর্তমানে শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যা ১ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। অথচ দেশে ১ লক্ষের বেশি বিদ্যালয় আছে, যেগুলি ১ জন মাত্র শিক্ষক দিয়ে চালু আছে। এমন ৮ হাজার স্কুল রয়েছে যেখানে কোনো পড়ুয়া নেই, অথচ শিক্ষক বা শিক্ষিকা আছেন। ফলে একটা বিষয় পরিষ্কার দেশে সরকারী শিক্ষাব্যবস্থায় প্রচুর অর্থ ও মানবসম্পদ বিনিয়োগ সত্ত্বেও সেই অচলায়তনের মধ্যেই আটকে আছে গোটা ব্যবস্থা। স্কুল আছে শিক্ষক নেই, শিক্ষক আছেন তো পড়ুয়া নেই, পরিকাঠামো আছে, তো সঠিকভাবে সেগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে একপ্রকার বাধ্য হয়েই বেসরকারী শিক্ষাব্যবস্থার দিকে ঝুঁকছেন অভিভাবকরা। আবার এটাও মনে করা হচ্ছে, সরকারের হাতে থাকা সিবিএসই বোর্ডের স্কুলগুলো পরীক্ষায় যথাযথ পারফর্ম করতে পারছে না। বাবা মা নুন-ভাত খেয়ে হলেও সন্তানের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে একটু ভালো পরিকাঠামো, নিরাপদ ক্যাম্পাস, বাহ্যিক চাকচিক্যের কারণে বেসরকারী স্কুলে ছুটছেন। তেমনি পরিষ্কার শৌচালয় ও পানীয় জলের মতো জরুরি বিষয়গুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সরকারী স্কুলে উপেক্ষিত থাকে।এভাবেই ক্ষয়রোগ বাড়ছে সরকারী স্কুলগুলোতে।