October 22, 2025

সমাজবিপ্লবী লালন

 সমাজবিপ্লবী লালন

বিপ্লবী শব্দের মানে সব সময়ই অনায়াসে রাষ্ট্র বা ক্ষমতা উৎখাত নয়। সামাজিক,নৈতিক, সাংস্কৃতিক ও মানসিকস্তরে যে মৌলিক বিভাজন, শ্রেণী-প্রথা, ধর্মীয় বিভাজন বা ব্যক্তিত্বগত দাসত্ব ভাঙে সেটাও অবশ্যই বিপ্লব। বাঙলায় লালন ফকির ঐ সব কাঠামোর টানহীনতা, অস্তিত্ব-স্বীকৃতি ও নতুন জ্ঞানের বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দেন, সেই হেতু তাকে বিপ্লবী বলে মানতেই হবেই। সেই জন্য সেই সময়কার যারা লালনকে সমালোচনা করেছেন, আলোচনা করেছেন তারা কেউ কেউ তাকে বাংলার প্রথম বিপ্লবী বলেছেন, যিনি সাম্য সমাজতন্ত্রের ভাবনা ভেবেছিলেন। লালন ধারাবাহিকভাবে জাত/ধর্ম বিভাজনকে অগ্রাহ্য করেন। তিনি আধ্যাত্মবাদের পথ থেকেও মানুষেক ধর্মীয় মোড়কে পরিচয় করাতে চাননি। কমিউনিস্টরা যে ডি-কাস্ট হবার কথা বলে থাকেন লালন সেই পথে বাংলাদেশে প্রথম শুদ্ধ ব্যক্তি।
লালন সেদিনও আক্রান্ত ছিলেন, পালনপন্থীরা আজও আক্রান্ত। লালনের জন্ম-মৃত্যু, কর্মস্থল বা লীলাভূমি সবই পড়েছে বিভাজিত বাংলার পূর্ব পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশে। ২০২৪ সালে বাংলাদেশে ছাত্র অভ্যুত্থানের এক ধর্মীয় উগ্রতা সেই দেশের সমাজে মাথা চাড়া দিয়েছে। ভারত সরকার বারবার ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর আক্রমণ নামিয়ে আনার কথা বলেছেন বিভিন্ন ফোরামে। সংখ্যালঘু মানুষদের সুরক্ষার প্রশ্নটি এসেছিল দুই দেশের শীর্ষ নেতাদের আলোচনাতেও। প্রচুর হিন্দু মন্দির ভাঙা হয়, পোড়ানো হয়েছে। দেখা গেছে, তার চেয়েও বেশি আক্রান্ত হয়েছে মাজারগুলি মাজারের ওপর আক্রমণ এখনও চলছে। ডজার সংস্কৃতিতে ভেঙে দেওয়া হচ্ছে মাজার। প্রাচীন গাছ কেটে ফেলা, লালনপন্থীদের পাগল বলে দাগিয়ে দিয়ে রাস্তাঘাটে ধরে তাদের চুল দাড়ি কেটে দেওয়ার কাজগুলি সমাজের নিন্দিত হলেও উগ্র ধর্মীয় লোকেরা তাদের প্রাতিষ্ঠানিকতায় এই সব আপত্তিকে পাত্তা দিচ্ছে না। ইসলামের নামে এই অপকর্মগুলি চালিয়ে যাচ্ছে।
ফলে এই উপমহাদেশের সমাজ সাংস্কৃতিকতায় লালন সাঁই আবারো আলোচ্য হয়ে উঠেছেন। এই সময়ে বাংলাদেশের কুষ্টিয়ায় লালনের বারামখানায় (সমাধি / বিশ্রামস্থল) তার প্রয়াণ উপলক্ষ্যে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় বড়সড় মেলা চলছে। সামাজিক মাধ্যম তার ভালোমন্দ দেখাতে তৎপর। একটি ঘটনা সারা দুনিয়াকে তাক লাগিয়েছে উৎসবের সরকারী মঞ্চে নির্ধারিত শিল্পীদের মঞ্চে আসা যাওয়ার ফাঁকে লালন অনুরাগী এক ‘পাগল’ মঞ্চে উঠে মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে নেন। তাঁকে নামিয়ে দিতে আয়োজকেরা দুইবার টানা হ্যাচড়া, চড়-থাপ্পড় মেরেও ব্যর্থ হন। নিজের জায়গায় নিগ্রহের শিকার হয়েও একটা গান গেয়ে সবাইকে মুগ্ধ করে দিয়ে যান এই ‘পাগল’। লালন অনুরাগীরা জানেন, নিগ্রহ তাদের ভবিতব্য। এর পরেও লালনের বাণী ছড়িয়ে দিয়ে নিজেদের কাজটা তারা করে যান।
প্রতিষ্ঠানিক ধর্ম বা ইসলামী কট্টরবাদ লালনপন্থীদের ‘জয়গুরু’ সম্ভাষণ নিয়ে যেমন আপত্তি তুলে থাকেন তেমনি লালন সাঁই এর গানে ব্যবহৃত উর্দু শব্দ, যেগুলি মূলত কোরানের ভাষা সেই গুলির মাধ্যমে লালনকে ধর্মীয় দখলদারির বৃত্তে নিতে চান। তারা চান লালনের আখড়া বা মাজারগুলিতে গান বন্ধ হয়ে যাক। কিন্তু লালন তো লালন। জাত ধর্ম ও সামাজিক অবস্থান চ্যালেঞ্জ করে লালন নিজে বাউল, ফকির ঐতিহ্যের ধারক ছিলেন। তিনি উচ্চ-নিম্ন শ্রেণীর গণ্ডি ভাঙেন। প্রকৃত জীবনে শিষ্য-শ্রেণী, আচার-ধর্ম, পরিচয়চিহ্ন না মেনে চলা সেটাই শ্রেণী-ভিত্তিক সমাজবিন্যাসের বিরুদ্ধাচরণ। সেই সময়ে কোনে এখনো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মধারী সমাজের চোখে এটা একটা মুখ্য উপদ্রব। সংঘাত সেখানেই।
লালনের ঘরে, পদে নারীর উপস্থিতি, নারী কন্ঠের মর্যাদা ও অংশ্রগ্রহণ ছিল স্বাভাবিক। রাজনৈতিক অর্থে নয়, কিন্তু সামাজিক-নৈতিক দিক থেকে লিঙ্গভিত্তিক ভূমিকা ও বিধিনিষেধকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। বস্তুত তিনি রীতিনীতির বাইরের জীবনচর্চা ও আধ্যাত্মিক স্বাধীনতার কথা বলেছিলেন।রীতিকে ধর্মের নাম করে মানুষের উপর চাপানো শৃঙ্খল ভেঙে দেওয়াই তার বার্ত ছিলো।ধর্মীয় নিয়মানুযায়ী পবিত্রতা/অপবিত্রতার ধারণা বিনষ্ট করে উড়িয়ে দেওয়ার মতো শক্তিশালী পরিবর্তন তার কথার মধ্যে রয়েছে বলেই মানুষ আজও তার অনুসারী।প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম তাঁকে উপদ্রব মনে করলেও শেষ করে দেওয়ার ক্ষমতা বাঙলায় আজও ধরে না।অপরিচিত, অবহেলিত মানুষকে মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় তার পথ ও মত আজও বিরাট ভূমিকা রাখে াউল, পাগল, ফকিরদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করে তিনি নিম্নবর্গের মানুষ,
যারা আজও সংখ্যাগরিষ্ঠ ও অবদমিত- তাদের কণ্ঠকে একটি নৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিচিত পরিসরে তুলে এনেছিলেন। এটাও এক শক্তিশালী সামাজিক পুনর্গঠন। এ কথা ঠিক যে লালন যে কাজটি করেছেন তা তিনি প্রথম করেননি। তার আগেও কেউ, হয়তো তার গুরু সিরাজ সাঁই কাজটি শুরু করেছিলেন; কিন্তু বিপ্লব মানে সদা নতুন কিছু হতে হবে এমন নয়। ধারাবাহিকতা থেকে এমনভাবে প্রয়োগ বা বিকাশ ঘটানো আরও বড় কাজ। ধারাবাহিকতার মধ্যে বিপ্লবী উপাদান থাকতে পারে এবং লালনের কাজ তেমনই ছিল। পুরনো ধারা থেকে মানব-অনূভূতির পুনর্গঠন ঘটানো সততই গুরুত্বপূর্ণ কাজ।বাঙলার লালনপন্থীরা তীব্র আক্রমণ উপেক্ষা করে এগিয়ে যাচ্ছেন। কারণ এর সঙ্গে বাঙলা,বাঙালীর অস্তিত্বের প্রশ্ন জড়িয়ে থাকছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *