October 20, 2025

সতর্কের পথচলা

 সতর্কের পথচলা

আন্তর্জাতিক রাজনীতির জটিল দাবার ছকে ভারত ঠেকে শিখে, অত:পর তার কূটনৈতিক কৌশল নতুন করে সাজিয়েছে।
নরেন্দ্র মোদি সরকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সম্পর্কে যে পরিপক্কতা ও সতর্কতা দেখিয়েছে, তা প্রশংসার দাবিদার। তবে, ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গেও একই ধরনের কৌশলগত দূরত্ব বজায় রাখাও এখন সময়ের দাবি। এই পুন:সামঞ্জস্য ভারতের বিশ্ব মঞ্চে স্বাধীন অবস্থান এবং দক্ষিণ এশিয়ার নেতৃত্বকে আরও শক্তিশালী করবে। সম্প্রতি মিশরে গাজার যুদ্ধবিরতি উপলক্ষে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পৌরোহিত্যে ‘গাজা পিস সামিট’ শীর্ষক আয়োজিত বিব্রতকর একটি অনুষ্ঠানে বিশ্বনেতারা তার নির্দেশে মঞ্চে হাজির হয়েছিলেন। আনুষ্ঠানটি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ ট্রাম্পের প্রশংসায় এতটাই মুগ্ধ ছিলেন যে ট্রাম্প নিজেই বিব্রত হন। ফিফা প্রধান জিয়ান্নি ইনফান্তিনোর মতো কেউ কেবল ট্রাম্পের ডাকে অকারণে উপস্থিত ছিলেন সেখানে। এমন অদ্ভুত প্যারেডে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অনুপস্থিত থেকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। শেষ মুহূর্তের আমন্ত্রণ সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী নিজে না গিয়ে, এমনকী বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্করকেও না পাঠিয়ে, বিকল্প হিসেবে বিদেশ প্রতিমন্ত্রী কীর্তিবর্ধন সিংকে পাঠিয়ে ভারতের মর্যাদা রক্ষা করেছেন। এই সিদ্ধান্ত ভারতের কৌশলগত প্রজ্ঞা ও বিশ্ব মঞ্চে স্বাধীন অবস্থানের প্রমাণ। আবার কীর্তিবর্ধন সেখানে গিয়ে ভারতের তরফে ভারসাম্যের কূটনীতি রক্ষা করেছেন। তিনি মিশনের প্রেসিডেন্ট সিসির সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন এবং সর্বোপরি ট্রাম্পের সঙ্গে ছবি তোলেন। এছাড়া, তিনি ‘ট্রাম্প ডিক্লারেশন ফর এনডিওরিং পিস অ্যান্ড প্রসপারিটি’ স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন।


এই কূটনীতি আদতে ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ গোত্রীয়, কূটনৈতিক পরিপক্কতার সমতুল এবং সময়েরও দাবি। ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে ভারতের উপর পঞ্চাশ শতাংশ আমদানি শুল্ক আরোপ, ভারতীয় অর্থনীতির প্রতি উপহাস এবং পাকিস্তানের সঙ্গে একতরফা শান্তি আলোচনার দাবি ভারতের উদ্বেগকে উপেক্ষা করেছে। এই শুল্ক ভারতীয় রপ্তানি খাতে; বিশেষ করে কৃষি, তথ্যপ্রযুক্তি, টেক্সটাইল এবং ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্পে চাপ সৃষ্টি করেছে। এটি ভারতীয় বাজারে মূল্যবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। অতীতে মোদি ট্রাম্পের সঙ্গে ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব গড়তে চেয়েছিলেন। হিউস্টন ও আহমেদাবাদে যৌথ সমাবেশ এবং ২০২০ সালের নির্বাচনে ট্রাম্পের সমর্থনে মোদির উৎসাহজনক মন্তব্য (যা নয়াদিল্লী ভুল ব্যাখ্যা বলে দাবি করে) এর প্রমাণ। কিন্তু ট্রাম্পের দলের ভারতবিরোধী বর্ণবাদী মন্তব্য এবং তার অপ্রত্যাশিত নীতি পরিবর্তনের পর মোদি সতর্ক দূরত্ব বজায় রেখেছেন। সামাজিক মাধ্যমে ট্রাম্পের প্রশংসা করলেও, মিশনের মতো ঘটনা এড়িয়ে তিনি ভারতের জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। এই কৌশল দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের নেতৃত্বকে শক্তিশালী করেছে, বিশেষ করে পাকিস্তানের সঙ্গে ট্রাম্পের একতরফা কথোপকথনের প্রেক্ষাপটে, যা ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের সংবেদনশীল ভারসাম্যকে জটিল করে তুলতে পারে।
অন্যদিকে, নেতানিয়াহুর সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে একই সতর্কতার অভাব ঝুঁকিপূর্ণ। গাজায় অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি সত্ত্বেও নেতানিয়াহু তার লক্ষ্য ত্যাগ করেননি; পশ্চিম তীর দখল, প্যালেস্টাইনি রাষ্ট্র গঠনে বাধা এবং গাজার সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিজে) ২০২৪ সালে গাজায় গণহত্যার অভিযোগে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে, যা তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের গুরুতর অভিযোগের প্রতিফলন। ইজরায়েলে সম্প্রতি উৎসবমুখর সমাবেশে তার নামে হট্টগোল নেতানিয়াহুর অ-জনপ্রিয়তার প্রমাণ। অথচ মোদি প্রকাশ্যে নেতানিয়াহুর নেতৃত্বের প্রশংসা করে চলেছেন, যা ভারতের নৈতিক অবস্থানকে প্রশ্নের মখে ফেলতে পারে। ইজরায়েলের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক, প্রতিরক্ষা, সাইবার নিরাপত্তা, কৃষি প্রযুক্তি এবং জল ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতা – জাতীয় স্বার্থের জন্য অপরিহার্য। এই সম্পর্ক ভারতের সামরিক আধুনিকীকরণ এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে, এই সহযোগিতা নেতানিয়াহুর ব্যক্তিগত রাজনৈতিক ভাগ্যের উপর নির্ভর করা উচিত নয়। ট্রাম্পের সঙ্গে সতর্কের দূরত্ব বজায় রেখে ভারত যেমন বিশ্ব মঞ্চে নিজের মর্যাদা ও স্বাধীনতা রক্ষা করেছে, নেতানিয়াহুর ক্ষেত্রেও অনুরূপ কৌশল বিধেয়। ভারতের এই কূটনৈতিক পরিপক্কতা দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতায় অবদান রাখবে এবং ভারতীয় নাগরিকদের জন্য গর্বের বিষয়। বিশ্ব রাজনীতিতে ভারতের ক্রমবর্ধমান প্রভাব এবং স্বাধীন নীতি বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী অর্থনীতি ও কূটনৈতিক শক্তি হিসেবে দেশের অবস্থানকে আরও মজবুত করছে। ইতিহাস যখন নেতানিয়াহুর উত্তরাধিকার লিখবে, ভারত যেন নৈতিকতা ও কৌশলগত স্বার্থের সঠিক ভারসাম্যের পক্ষে দাঁড়ায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *