শিক্ষক যখন কেরানি!

আমরা সকলেই জানি, শিক্ষা একটি সভ্য ও সুশৃঙ্খল জাতি গঠন করে।আর সেই জাতি গঠনের প্রধান কারিগর হচ্ছেন শিক্ষক।শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। আর শিক্ষকরা হলেন সেই মেরুদণ্ড গড়ার কারিগর।তাই শিক্ষককে জাতির মেরুদণ্ডও বলা হয়।একটি আদর্শ, নীতি-নৈতিকতা বোধসম্পন্ন জাতি তৈরির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কোনটি? এর সঠিক জবাব হলো নৈতিক জ্ঞানসম্পন্ন প্রাথমিক শিক্ষা। শিক্ষাই আলোকিত সমাজ বিনির্মাণের হাতিয়ার। শিক্ষক হলো তার সুনিপুণ কারিগর। শিক্ষা ছাড়া আলোকিত মানুষ সৃষ্টি, (যাকে আমরা ‘হুঁশ’ যুক্ত মানুষ বলে থাকি) তা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
একজন শিক্ষকের বেশকিছু দায়বদ্ধতা আছে।এই দায়বদ্ধতা সমাজের কাছে, দেশ ও জাতির কাছে। একজন সফল মানুষের পিছনে শিক্ষকের বিশাল বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। শিক্ষক শুধু সফল নয়, একজন ভালো মানুষ হতে শেখান। শিক্ষক হচ্ছেন সভ্যতার ধারক-বাহক। একজন শিক্ষক শুধু শিক্ষাদানই করেন না, তিনি মানুষ গড়ার কারিগরও। পিতা-মাতা আমাদের জীবনদান করেন ঠিকই। কিন্তু শিক্ষকরা জীবনকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে সাহায্য করেন। এই বিশ্বের অনেক বিখ্যাত দার্শনিক শিক্ষক ও শিক্ষক সমাজ নিয়ে অনেক কথা বলেছেন। এগুলো বলে বা লিখে শেষ করা যাবে না। উদাহরণ হিসাবে দুজনের কথা উল্লেখ করছি। যেমন আমেরিকার প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ হেনরি এডামস শিক্ষকের গুরুত্ব সম্পর্কে বলেছেন, একজন শিক্ষক সামগ্রিকভাবে প্রভাব ফেলেন, কেউ বলতে পারে না তার প্রভাব কোথায় গিয়ে শেষ হয়। প্রখ্যাত দার্শনিক বলেছেন, শিক্ষক সমাজ হচ্ছেন প্রকৃতই সমাজ ও সভ্যতার বিবেক।তাই তো শিক্ষকদের বলা হয় ‘সোশ্যাল ইঞ্জিনীয়ার’ তথা সমাজ নির্মাণের স্থপতি।
শিক্ষা ও শিক্ষক নিয়ে শুরুতে এতগুলো কথা বলার একটাই কারণ। বর্তমান সময়ে শিক্ষা এবং শিক্ষকের গুরুত্ব বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে বিশ্লেষণ করলে, রাত-দিনের ফারাক লক্ষ্য করা যায়। শিক্ষা এবং শিক্ষক উভয়ের গুরুত্ব দিনকে দিন তলানিতে গিয়ে ঠেকছে। শিক্ষক এখন তাদের আসল কাজ ছেড়ে, অর্থাৎ শিক্ষিত এবং সভ্য জাতি গঠনের কাজ ছেড়ে, কেরানির কাজে লিপ্ত হয়েছেন। মোদ্দা কথা, শিক্ষক এখন কেরানি। কথাটা শুনতে খারাপ লাগলেও, এটাই এখন বাস্তব ঘটনা। স্কুলে স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের পাঠদানের বদলে শিক্ষকরা এখন কেরানির কাজ করছেন। আরও স্পষ্ট করে বললে, করতে বাধ্য হচ্ছেন। কেননা, সরকার এখন শিক্ষকদের দিয়ে যাবতীয় কাজ করাচ্ছে। বলতে গেলে ‘জুতো সেলাই – থেকে চণ্ডীপাঠ’ সবই এখন শিক্ষকদের দিয়ে করানো হচ্ছে। ফলে শিক্ষকের মর্যাদা ও কাজের ধরন নিয়ে সমাজে প্রচলিত ধারণা এবং বাস্তবতার মধ্যে একটি বড় ধরনের বৈপরীত্য এবং অসঙ্গতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শিক্ষক এখন আর শিক্ষক নন। শিক্ষক এখন শিক্ষা দপ্তর থেকে শুরু করে রাজ্য সরকারের অন্য দপ্তরগুলির বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি রূপায়ণের কাজে সবথেকে বেশি ব্যস্ত থাকছেন। ফলে লাটে উঠেছে স্কুলগুলিতে ছাত্রছাত্রীদের পাঠদান। এমনিতেই বর্তমান সময়ে স্কুলগুলিতে শিক্ষকের চরম সংকট। শিক্ষকের দাবিতে প্রায়ই ছাত্রছাত্রীদের রাস্তায় নেমে সরব হতে হচ্ছে। এর মধ্যে যেক’জন শিক্ষক বা শিক্ষিকা আছেন, তারা প্রত্যেকেই সরকারের অন্য নির্দেশ পালনে ব্যস্ত।
অথচ আমরা সকলেই জানি, শিক্ষকতা হচ্ছে একটি মহান পেশা। যার উপরে জ্ঞান বিতরণ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ার গুরুদায়িত্ব ন্যস্ত থাকে। অন্যদিকে, কেরানি মূলত অফিসের হিসাবনিকাশ, নথিপত্র সংরক্ষণ ও অন্যান্য প্রশাসনিক কাজের সাথে জড়িত। যখন একজন শিক্ষককে কেরানির মতো কাজ করতে হয়, তখন তার শিক্ষকের ভূমিকা গৌণ হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, এটি যেকোনো দেশ বা রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থার অত্যন্ত নেতিবাচক একটি দিক বলেই বিবেচিত হয়। দেশের উত্তরপূর্বের ছোট রাজ্য ত্রিপুরাও সেই ভয়ঙ্কর পথে হাঁটছে। এই রাজ্যে তো শিক্ষকরা বহু আগে থেকেই কেরানির ভূমিকা পালন করে চলেছেন। সেই পরম্পরা আজও অব্যাহত। এখন পরিস্থিতি আরও খারাপ। যত দিন যাচ্ছে, শিক্ষকরা তাদের মূল দায়িত্ব থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন। বলা ভালো, দূরে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এতে শিক্ষাদান প্রক্রিয়া মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। শুধু তাই নয়, এতে শিক্ষকদের পেশাগত জীবনেও অসন্তুষ্টি বাড়ছে। এতে সবথেকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। এখানেই শেষ নয়, সমাজে শিক্ষকের সম্মান ও মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থাও দিন দিন কমে যাচ্ছে। এই প্রবণতা আগামী দিনে আরও ভয়ঙ্কর রূপ নেবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই! কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে? সেটাই সবথেকে বড় প্রশ্ন। ‘শিক্ষক যখন কেরানি’ তখন জাতি গঠন, সমাজ গঠন, মানুষ গঠন- এইসব কথা বলে কোনো লাভ আছে কি?