শরীরে ভিটামিন ডি ও ভিটামিন বি১২-এর ঘাটতি: নীরব ঘাতক, প্রতিকার ও প্রতিরোধ!!

দৈনিক সংবাদ অনলাইন :-আমাদের দেহ সুস্থভাবে চলতে গেলে শুধু প্রোটিন, শর্করা বা চর্বি নয়, প্রয়োজন মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টস বা ক্ষুদ্র উপাদানের, যাদের মধ্যে ভিটামিন ডি (Vitamin D) ও ভিটামিন বি১২ (Vitamin B12) অন্যতম। আধুনিক ব্যস্ত জীবনযাত্রা, খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন ও সূর্যালোকের অভাবে এই দুই ভিটামিনের ঘাটতি আজ একটি নীরব মহামারী রূপে দেখা দিয়েছে, বিশেষত উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলিতে, যেখানে আবহাওয়া, খাদ্যসংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার ধরনে এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। এই নিবন্ধে আমরা আলোচনা করব কীভাবে শরীরে এই দুটি ভিটামিনের অভাব আমাদের দৈহিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে এবং তা থেকে বাঁচার উপায় কী হতে পারে।
ভিটামিন ডি: সূর্যের ভিটামিন
উৎস: ভিটামিন ডি মূলত সূর্যালোকের
মাধ্যমে শরীরে তৈরি হয় (UV-B রশ্মির সংস্পর্শে ত্বকে সৃষ্ট)।এছাড়া কিছু খাবারে (যেমন: ডিমের কুসুম, চর্বিযুক্ত মাছ, মাশরুম, দুধের তৈরি খাবার) সামান্য পরিমাণে পাওয়া যায়।
ঘাটতির কারণ:সূর্যের আলোতে কম সময় থাকা অতিরিক্ত সানস্ক্রিন ব্যবহার
অধিকাংশ সময় ইনডোরে থাকা গা ঢাকা পোশাক পরা গর্ভাবস্থা ও স্তন্যদানের সময় বিশেষ চাহিদা শাকাহারী খাদ্যাভ্যাস
উপসর্গ: হাড়ের ব্যথা ও দুর্বলতা
(অস্টিওম্যালেসিয়া) পেশির ব্যথা ও খিঁচুনি অতিরিক্ত ক্লান্তি হতাশা ও মানসিক অবসাদ ঘন ঘন অসুখ-বিসুখ (ইমিউনিটির ঘাটতি)
শিশুদের ক্ষেত্রে হাঁটার বিলম্ব বা পায়ের বাঁকা হওয়া (Rickets)
শরীরের অন্যান্য অঙ্গের সঙ্গে সম্পর্ক: হাড় ও দাঁত: ক্যালসিয়াম শোষণের জন্য ভিটামিন ডি অত্যাবশ্যক, এর অভাবে হাড় ক্ষয় হয়।
হৃদপিণ্ড: রিসার্চে দেখা গেছে,ভিটামিন ডি-এর অভাবে উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে।
ইমিউন সিস্টেম: বিভিন্ন ভাইরাস
ও ব্যাকটেরিয়া থেকে রক্ষা করতে এই ভিটামিন এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
মস্তিষ্ক: বিষণ্ণতা, অ্যালঝাইমার বা মানসিক অসাড়তার পেছনেও ঘাটতির ভূমিকা আছে।
ভিটামিন বি১২ (Vitamin B12): স্নায়ু ও রক্তের ভিটামিন
উৎস:এই ভিটামিন প্রধানত প্রাণীজ উৎসে ডিম ইত্যাদি। উদ্ভিজ্জ উৎসে এটি প্রায় অনুপস্থিত।পাওয়া যায়: যেমন দুধ, মাছ, মাংস,ডিম ইত্যাদি।উদ্ভিজ্জ উৎসে এটি প্রায় অনুপস্থিত।
ঘাটতির কারণ:সম্পূর্ণ নিরামিষ খাদ্যাভ্যাস পেটের অ্যাসিডের মাত্রা কমে যাওয়া (যেমন: বৃদ্ধ বয়সে বা দীর্ঘদিন অ্যাসিডের ওষুধ খেলে) পেটের অপারেশন বা রিসেকশন. দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিসের জন্য মেটফর্মিন খাওয়া অন্ত্রের রোগ যেমন সিলিয়াক ডিজিজ বা ক্রোন্স
উপসর্গ:দুর্বলতা, ক্লান্তি নিঃশ্বাসে কষ্ট ও হৃদকম্পন জিহ্বা জ্বালা বা লাল হয়ে যাওয়া হাত-পা ঝিনঝিন বা অসাড় ভাব
মুড সুইং, অবসাদ স্মৃতিভ্রংশ, ঘোর লাগা শিশুদের ক্ষেত্রে বিকাশে বিলম্ব
শরীরের অন্যান্য অঙ্গের সঙ্গে সম্পর্ক
রক্ত: এর অভাবে মেগালোব্লাস্টিক এনিমিয়া হয়, যেখানে RBC বড় ও অকেজো হয়।
স্নায়ুতন্ত্র: দীর্ঘমেয়াদে ঘাটতি থাকলে ইরিভার্সিবল নিউরোপ্যাথি হতে পারে।
মানসিক স্বাস্থ: বিষণ্ণতা ও বুদ্ধির ঘাটতির সঙ্গে স্পষ্ট সম্পর্ক আছে।
হজমতন্ত্র: ক্ষুধামান্দ্য, বদহজম ও কোষ্ঠকাঠিন্যের কারণ হতে পারে।
পূর্বোত্তর ভারতের প্রেক্ষাপটে: ত্রিপুরা, আসাম, মেঘালয় ও মণিপুরের মতো রাজ্যগুলিতে গড়ে ৬০% নাগরিকের মধ্যে ভিটামিন ডি ও বি১২-এর কিছু না কিছু মাত্রার ঘাটতি লক্ষ্য করা যায়। প্রচুর মানুষ সকালে সূর্যস্নানের সুযোগ পান না, বা খাদ্যাভ্যাসে প্রাণীজ উৎসের ঘাটতি থাকে। শিশু, গর্ভবতী নারী, বৃদ্ধ ও দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্তরা এই ঘাটতির ঝুঁকিতে বেশি থাকেন।
প্রতিরোধ ও প্রতিকার:ভিটামিন ডি:
প্রতিদিন অন্তত ২০-৩০ মিনিট খালি ত্বকে (হাত-মুখ বা পা) সূর্যালোক লাগানো
সপ্তাহে অন্তত ৩ দিন ডিম, মাছ, দুধ, মাশরুম খাওয়া
প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শে বছরে ৬-১২ সপ্তাহ ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট নেওয়া (যেমন: Cholecalcif-erol 60,000 IU weekly)
ভিটামিন বি১২:খাদ্যে মাছ, দুধ, ডিম, পনির, দই অন্তর্ভুক্ত করা নিরামিষভোজীরা বছরে অন্তত
একবার রক্ত পরীক্ষা করিয়ে সাপ্লিমেন্ট নেওয়ার কথা ভাবতে পারেন
দীর্ঘদিন মেটফর্মিন বা অ্যান্টাসিড
খেলে বি১২ পরীক্ষা বাধ্যতামূলক
সচেতনতা ও বার্তা:আজকের দিনে এই দুটি ভিটামিনের ঘাটতি আমাদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যকে গভীরভাবে প্রভাবিত করছে। অথচ এই সমস্যার প্রতিকার সহজ ও সস্তা – সঠিক খাদ্যাভ্যাস, কিছুটা সূর্যস্নান, এবং সময়মতো রক্ত পরীক্ষা। চিকিৎসকের পরামর্শে উপযুক্ত ডায়েট ও সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করলে আমরা সহজেই এই ঘাটতির নেতিবাচক প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে পারি।
উপসংহার:নীরব এই ভিটামিন ঘাটতি যদি অগ্রাহ্য করা হয়, তাহলে তা দীর্ঘমেয়াদে হার্ট, ব্রেন, স্নায়ু ও হাড়কে স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের আরও সচেতন হয়ে প্রতিটি রোগীর প্রাথমিক পর্যায়ে এই ঘাটতির বিষয়ে নজর দেওয়া প্রয়োজন। সতর্ক থাকুন, সুস্থ থাকুন