December 15, 2025

লোক ভবন ও বাস্তবতা

 লোক ভবন ও বাস্তবতা

দেশের রাজভবনগুলির নাম এখন থেকে লোক ভবন’।কেন্দ্র ইতিমধ্যেই সেই প্রস্তাবে সিলমোহর দিয়েছে ২৫ নভেম্বর, ২০২৫-এর এক নোটিফিকেশনে।সংশ্লিষ্ট নির্দেশনায় বলা হয়েছে রাজভবন ও রাজনিবাসকে যথাক্রমে ‘লোক ভবন’ এবং ‘লোক নিবাস’-এ রূপান্তর করা হবে।সরকার এটিকে কেবল নাম পরিবর্তন হিসেবে দেখছে না; বরং ‘জন-উদ্যোগে’ ও ‘জন-সম্মুখী’ প্রশাসনিক ভাবনার এক প্রতীক হিসেবেই সামনে আনা হচ্ছে।
সরকারী মহলে সাফ জানানো হয়েছে- রাজভবন অতীতের সেই অলঙ্কৃত, দূরবর্তী, ঔপনিবেশিক ক্ষমতার প্রতীক নয়।গত তিন বছরে বহু রাজ্যেই রাজভবন জেলা পর্যায়ে নেমে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছে- দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা থেকে নির্যাতন ও অভিযোগ তদন্ত, জনদুর্ভোগে দ্রুত হস্তক্ষেপ ইত্যাদি। নতুন নামে সেই কার্যক্রমকে আরও আইনি কাঠামো ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার চেষ্টা চলছে। ভারতের গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় নাকি এটিই নব্য প্রতীক। কিন্তু এই ঘোষণার মধ্যে যতটা উচ্চকিত শব্দ, তার বাস্তবে কি ততটাই গণতান্ত্রিক রূপান্তর ঘটবে? সন্দেহ থেকেই যায়-কারণ ভারতীয় প্রশাসনিক ধারায় নাম বদলই বহুদিন ধরেই প্রকৃত সংস্কারের বিকল্প হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ব্রিটিশ আমলে গভর্নমেন্ট হাউস বা লাটভবন-আসলে ছিল শাসকের দুর্গ, একধরনের রাজনৈতিক দুর্গন্ধের ঘেরাটোপ। স্বাধীনতার পর সেই ঘেরাটোপ কেবলমাত্র রঙ-রূপ বদলে হয়ে গেল ‘রাজভবন’। ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো তৈরি হলেও, এই প্রতিষ্ঠানগুলির চরিত্র কিন্তু ঔপনিবেশিকই রয়ে গেল-উচ্চাশয়, অপরিসীম ব্যয়, বিচ্ছিন্ন ভিআইপি সংস্কৃতি এবং গণতন্ত্র- বিমুখ ক্ষমতার প্রতীক। আজ যখন সেই নাম মুছে ‘লোক ভবন’ রাখা হচ্ছে, তখন বড় প্রশ্ন- প্রতিষ্ঠানের চরিত্র কি সত্যিই বদলাবে, নাকি কেবল রূপের মোড়ক পাল্টানো? নাম বদলের যুক্তি হিসেবে বলা হচ্ছে-রাজভবন নাকি গত তিন বছরে জেলা পর্যায়ে নেমে দুর্যোগ মোকাবিলা ও কিছু তদন্তমূলক কাজে ভূমিকা নিয়েছে। কিন্তু সেই ভূমিকা ব্যতিক্রম, নিয়ম নয়। এক রাজ্যপালের সদিচ্ছা বা কোনও সময়ের বিচ্ছিন্ন সক্রিয়তা দিয়ে এ প্রতিষ্ঠানের গণতান্ত্রিক দায়বদ্ধতার প্রমাণ হয় না। সত্যিটা হচ্ছে- রাজভবন এখনও অত্যন্ত ব্যয়বহুল, কেন্দ্রের প্রতি নতজানু, রাজ্য সরকারের উপর ক্ষমতার ছায়া বিস্তারকারী এক অস্বাভাবিক প্রতিষ্ঠান। এ প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়া যায়না-ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতন্ত্রে রাজ্যপাল পদের অস্তিত্বগত প্রয়োজন আছে কোথায়? সংবিধান তাকে ‘বন্ধুত্বপূর্ণ পরামর্শদাতা’ বলেছে, অথচ বাস্তবে রাজ্যপাল পরিণত হয়েছেন কেন্দ্রের রাজনৈতিক প্রতিনিধি হিসেবে। অগণিত বিতর্ক আছে- সংবিধান লঙ্ঘন, রাজ্য সরকারকে বিপাকে ফেলা, অযাচিত হস্তক্ষেপ, অগণিত সুপারিশ, এবং রাজনৈতিক পক্ষপাত। এখন এই বিতর্ক-জর্জরিত প্রতিষ্ঠানকে ‘লোক ভবন’ বানালে কি তার আচরণ বদলাবে? সবচেয়ে বড় ভণ্ডামি প্রকাশ পায় ব্যয়ের খাতায়। রাজভবন বলতে আমরা বুঝি-বিলাসবহুল প্রাসাদ, লক্ষাধিক টাকার মাসোহারা, বিশাল গাড়ির বহর, তেল-খরচ, ব্যয়বহুল অনুষ্ঠান, অন্তহীন আপ্যায়ন, অগণিত কর্মী বাহিনী এবং কোটি কোটি টাকার রক্ষণাবেক্ষণ। এই প্রাসাদ-ব্যবস্থা জনগণের টাকায় চলে, অথচ জনগণের কাছে তার জবাবদিহি নেই। নাম ‘লোক ভবন’, কিন্তু ব্যয় ‘রাজ- ব্যয়’- এ কোন গণতান্ত্রিক সমীকরণ? নাম বদলকে সরকার বলছে ‘জনমুখী ভাববিকাশের ইঙ্গিত’। কিন্তু রাজ্যপালের ভিআইপি প্রোটোকল কি কমবে?
বিলাসহবহুল রাজকীয়তা কি পরিত্যক্ত হবে? গাড়ির বহর কি অর্ধেক হবে? রাজভবন- এখন ‘লোক ভবন’-তার বার্ষিক ব্যয় কি জনদরদে কমানো হবে?রাজ্যপাল পদের ক্ষমতা কি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সীমাবদ্ধ করা হবে? রাজ্যপালের সরকারী ব্যয়ের প্রতিবছরের নিরীক্ষা কি প্রকাশ করা হবে? যদি উত্তর ‘না’, তাহলে নাম বদল ভারতীয় রাজনীতির পুরনো রোগেরই পুনরাবৃত্তি-নাম পাল্টাও, ভাবমূর্তি পাল্টাও, কিন্তু ক্ষমতা ও বিলাসিতার আগের মতোই থাক।গণতন্ত্রে জনক্ষমতার প্রতীক হতে হলে রাজভবনকে সত্যিকারের সংস্কার চাইঃ খালি সাইনবোর্ড বদল নয়। বরং প্রয়োজন- রাজ্যপাল পদের সাংবিধানিক ক্ষমতা পুনর্মূল্যায়ন, ব্যয়ের ওপর কঠোর সীমা, ভিআইপি সংস্কৃতি বিলোপ, রাজভবন-রাজনীতি নয়, প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা, জনগণের প্রতি সরাসরি জবাবদিহি। নাম ‘লোক ভবন’ হলেই কি রাজভবন জনগণের? না।
যতক্ষণ পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানের ব্যয়, ক্ষমতা, আচরণ এবং ভূমিকা জনগণের নিয়ন্ত্রনাধীন না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত ‘লোক ভবন’ নামটি কেবলমাত্র রাজনৈতিক প্রচার-ভিতরের ঔপনিবেশিক মানসিকতা অপরিবর্তিত। এ শুধু নাম বদল নয়, বরং লোক দেখানো সংস্কার। প্রকৃত গণতান্ত্রিক সংস্কার তখনই হবে- যখন রাজ্যপালের চাকচিক্য ভেঙে পড়বে, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় বন্ধ হবে, এবং রাজ্যভবন সত্যিই জনগণের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। নইলে ‘রাজভবন’ যতটা অগণতান্ত্রিক ছিল, ‘লোক ভবন’ নামেও ঠিক ততটাই থাকবে- শুধু সাইনবোর্ড বদলাবে, চরিত্র নয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *