রূপালী আলোক রেখা

গণতন্ত্রের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত হয়ে আছে সমাজের ন্যায় পরায়ণতার একটি ধারণা। অর্থাৎ মানুষ যখন কোনো জটিল পরিস্থিতিতে অসহায় বোধ করেন, তার অধিকার ও ন্যায্য প্রাপ্তি থেকে যখন তিনি বঞ্চিত হন, তখন তার সামনে একটাই মাত্র পথ খোলা থাকে, আর সেটা হল ন্যায়ালয় বা বিচার ব্যবস্থা। কিছু সাম্প্রতিক বেশকিছু বছর ধরে বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে এটা প্রতীয়মান হচ্ছে যে, দেশের বিধিবদ্ধ সংস্থাগুলোর পাশাপাশি সাংবিধানিক সংস্থাগুলোর উপর জনগণ নানা কারণে ক্রমশই ভরসা হারাচ্ছেন। এই ভরসাহীনতা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মানুষের মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত থাকার প্রশ্নে বড়সড় সংশয় ও আশঙ্কার জন্ম দিচ্ছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ন্যায়বিচার ব্যবস্থাকেই মূলত সর্বোচ্চ নিরপেক্ষ স্থান হিসাবে ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু বিভিন্ন কারণে ন্যায়বিচার ব্যবস্থাটা যখন কোনো একটা দিকে হেলে পড়ে তখন সেটা গণতন্ত্রের জন্য বিপজ্জনক মোড় নিতে পারে। তাই সবসময়েই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার অন্যতম স্তম্ভ হিসাবে পরিচিত বিচার ব্যবস্থা যাতে স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ থাকে সেদিকে সকলেরই গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। কিন্তু অতীতে বিভিন্ন সময়ে ইতিহাসে দেখা গেছে, দীর্ঘ প্রচলিত নিরপেক্ষ ন্যায়ব্যবস্থার ইমারতটি নানা কারণে শাসকের চাপে ভেঙে পড়েছে কিংবা স্বৈরাচারী শক্তির হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছে। এর থেকে উত্তরণের জন্য সবার আগে প্রয়োজন বিচার ব্যবস্থার নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিচারকদের আচরণ ও বিভিন্ন কাজকর্মে একটি আচরণবিধি বলবৎ করা।
সম্প্রতি এ দেশের গণতান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থায় ন্যায়ালয়ের কিছু কিছু ঘটনা জনমনে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। বিশেষ করে সুপ্রিম কোর্ট এবং হাইকোর্টের বিচারপতিদের অবসরের পরে তাদের আকর্ষণীয় সরকারী পদে পুনর্নিয়োগের এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে যার সঙ্গে রাজনীতিকে কোনোভাবেই আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই। ঘটনা হল, কেন্দ্রে বর্তমানে ক্ষমতাসীন বিজেপি পরিচালিত সরকারের শাসনকালে বিচারপতিদের অবসরের পর বিভিন্ন ধরনের সরকারী আকর্ষণীয় পদ পাওয়া নিয়ে জনগণের মধ্যে বিস্তর গুঞ্জন ও আলোচনার ঝড় উঠেছে। বিচারপতি রঞ্জন গগৈ কিংবা বিচারপতি রঙ্গনাথন মিশ্র অবসরের পর রাজ্যসভার সদস্যপদে মনোনীত হয়েছেন। আবার এমন ঘটনাও ঘটতে দেখা গেছে, হাইকোর্টের বিচারপতির চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে অল্পদিনের মধ্যেই প্রকাশ্য ভোটের ময়দানে অবতীর্ণ হয়েছেন একজন বিচারপতি।যিনি একটি নির্দিষ্ট দলের টিকিটে ভোটে জয়ী হয়ে লোকসভায় সদস্যও নির্বাচিত হয়েছেন।যদিও এই প্রবণতা মোদি সরকারের শাসন আমলেই শুরু হয়েছে এমনটা ভাবা ভুল।এর আগেও অন্তত আধডজন ঘটনার সুনির্দিষ্ট ইতিহাস রয়েছে যেখানে বিচারপতি থেকে অবসর গ্রহণের পর তারা সরকারের বহু গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হয়েছেন। এদের মধ্যে বিচারপতি রাজিন্দার সাচার, বিচারপতি বিজয় বহুগুনা, বিচারপতি এম রামা জয়েস যেমন রয়েছেন, তেমনি বিচারপতি বাহারল ইসলাম, বিচারপতি এএম থিপসের মতো নামও রয়েছে। বিচারব্যবস্থার এই স্বচ্ছতা নিয়ে বহুদিন ধরে এই ধরনের অভিযোগ থাকলেও সম্প্রতি বিচারপতি যশোবন্ত শর্মার দিল্লীর বাসভবন থেকে নগদ অর্থ উদ্ধারের ঘটনা ঘিরে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। যদিও এই অর্থ উদ্ধারের তিন মাসের বেশি সময় পরেও বিচারপতির বিরুদ্ধে কোনো এফআইআর দায়ের হয়নি। ঘটনাক্রমে মাত্র দিন কয়েক আগে দেশের প্রধান বিচারপতি বিআর গাভাই অবসরের পর বিচারপতিদের সরকারী পদপ্রাপ্তি এবং তাদের রাজনীতিতে যোগদান নিয়ে যথেষ্ট উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। এই বিতর্কের পরিমণ্ডলেই মঙ্গলবার সংসদীয় কমিটিতে বিচারপতিদের অবসরকালীন সুবিধা নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন উঠেছে। কমিটির কিছু সদস্য, প্রয়োজনে কেন্দ্র নতুন করে বিল এনে এমন আইন তৈরির প্রস্তাবও করেছেন যাতে অবসরের পর পাঁচ বছর কোনো সরকারী পদে না বসতে পারেন বিচারপতিরা। এক্ষেত্রে তারা অবসরের পাঁচ বছরের মধ্যে রাজনীতিতে যোগ দিতে পারবেন না, রাষ্ট্রপতি মনোনীত সদস্য হিসাবে সাংসদ হতেও পারবেন না। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে এজলাসে বিচারপতিদের আচরণে রাশ টানতে তাদের আচরণে সংযতভাবে ফিরিয়ে আনার কথাও বলা হয়েছে। মোদ্দা কথায় বিচারপতিদের জন্য কিছু নির্দিষ্ট আচরণবিধি তৈরি করা বা কোড অব কন্ডাক্টের কথাও উঠে এসেছে। বহু আলোচিত ও বিতর্কিত এই বিষয় নিয়ে আগামীদিনে হয়তো কোনো সমাধানে পৌছানো যাবে। কিন্তু সবকিছুর পরে এত উৎকণ্ঠা ও সংশয়ের মধ্যেও রূপালী যে আলোক রেখা বিচার ব্যবস্থার ভেতর থেকেই উত্তরণের পথ দেখাচ্ছে সেটাই হলো আস্থা ও ভরসার জায়গা।