রতনের নেতৃত্বে কৃষির গৌরবময় উত্থান, ত্রিপুরায় প্রথম অর্গানিক কৃষি পণ্যের ক্রেতা-বিক্রেতা সম্মেলন!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-রাজ্যের কৃষি ইতিহাসে আজ এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো। বুধবার আগরতলায় অভিজাত এক হোটেলে আয়োজিত হলো ত্রিপুরার প্রথম অর্গানিক ক্রেতা-বিক্রেতা সম্মেলন। এটা এমন এক উদ্যোগ, যা শুধু কৃষকের সঙ্গে বাজারের সেতুবন্ধন গড়লো না, বরং ত্রিপুরার অর্গানিক কৃষিকে বিশ্বমানচিত্রে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে গেলো। অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করে কৃষি ও কৃষক কল্যাণ দপ্তরের মন্ত্রী রতনলাল নাথ ত্রিপুরার কৃষিতে ‘নীরব বিপ্লবের’ চিত্র তুলে ধরে বললেন, ত্রিপুরা অর্গানিক চাষে একটি শক্তিশালী ব্র্যান্ডে রূপ নিচ্ছে।

তার দাবি, ত্রিপুরার অর্গানিক পণ্য এখন শুধুই স্থানীয় বাজারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা দিল্লী, মুম্বই, বেঙ্গালুরু, কলকাতা, গুয়াহাটি ছাড়িয়ে ওমান, দুবাই, ঢাকা প্রভৃতি আন্তর্জাতিক বাজারেও প্রবেশ করেছে। তিনি বলেন, আজকের পৃথিবী শুধু খাদ্য খুঁজছে না- চাইছে নিরাপদ, রসায়নমুক্ত ও ট্রেসযোগ্য খাদ্য। অর্গানিক চাষ ভবিষ্যতের জন্য সবচেয়ে কার্যকর সমাধান।
তিনি জানান, গত তিন বছরে রাজ্য থেকে ১,৩৩২ মেট্রিক টনেরও বেশি অর্গানিক পণ্য, যেমন সুগন্ধী চাল, বার্ডস আই লঙ্কা, আদা, হলুদ ও আনারস- দেশ ও বিদেশে রপ্তানি করা হয়েছে। শুধু আনারসই রপ্তানি হয়েছে ৬৬৬ মেট্রিক টন, আদা ৫৭৪ মেট্রিক টন এবং সুগন্ধী চাল ৩৩ মেট্রিক টন। মন্ত্রী বলেন, এই সম্মেলন শুধু রাজ্য প্রশাসনের নয়, রাজ্যের সাধারণ কৃষকদের গৌরবের মঞ্চও বটে। ত্রিপুরার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত কৃষক ও ফার্মার প্রোডিউসার
কেম্পাানির (এফপিসি) প্রতিনিধিরা এখানে তাদের অর্গানিক পণ্য তুলে ধরেন দেশ এবং বিদেশের নামজাদা ক্রেতাদের সামনে। তারা জানান, কীভাবে পতিত জমি চাষের আওতায় এনে, রাসায়নিকমুক্ত পদ্ধতিতে চাষ করছেন কুইন ও কিউ প্রজাতির আনারস, বার্ডস আই লঙ্কা, সুগন্ধী চাল, কালো চাল, গন্ধরাজ লেবু, আদা ও হলুদ। এদিন এই ক্রেতা-বিক্রেতা সমাবেশে গোটা দেশ থেকে মোট ৩২টি ক্রেতা সংস্থা সহ রাজ্যের ৫টি সংস্থা মিলিয়ে মোট ৩৭টি ক্রেতা সংস্থা অংশ নিয়েছে। এরমধ্যে বহিঃরাজ্যের ২৫টি সংস্থার সঙ্গে রাজ্যের অর্গানিক ফসল উৎপাদকের ৪০টি মৌ স্বাক্ষরিত হয়েছে। এতে মোট ৩২ কোটি ৯৫ লক্ষ টাকার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
জিরানিয়া ও কুমারঘাট এলাকার কৃষকেরা জানান, ইতিমধ্যেই তারা দিল্লী ও গুয়াহাটিতে ১৫,০০০ কেজিরও বেশি অর্গানিক আনারস পাঠিয়েছেন। এটি শুধুই আর্থিক সাফল্য নয়-এটি কৃষকের আত্মবিশ্বাসের নবযুগ।
মন্ত্রী রতনলাল নাথ জানিয়েছেন, রাজ্যে ইতিমধ্যেই ২৫,০০০ হেক্টরেরও বেশি জমিকে সার্টিফায়েড অর্গানিক জমিতে রূপান্তরিত করা হয়েছে এবং গঠিত হয়েছে ৫৩টি অর্গানিক ফার্মার প্রডিউসার কোম্পানি। এগুলিকে স্বীকৃত সার্টিফিকেশন সংস্থা দ্বারা অনুমোদিত করা হয়েছে। বিশেষ উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে জিআই ট্যাগ প্রাপ্ত পণ্যের চাষে।
এই পণ্যগুলির পুষ্টিগুণ এবং বাজারযোগ্যতা অত্যন্ত উঁচু মানের। যেমন বার্ডস আই লঙ্কা- যার ক্যাপসাইসিন মাত্রা বেশি, এটি হজম শক্তি বাড়ায় এবং প্রাকৃতিক পেইন রিলিভার হিসেবেও কাজ করে। আবার হরিনারায়ণ ও কালিখাসা চাল শুধুমাত্র ঘ্রাণ ও স্বাদেই নয়, এর নরম গঠন ও রান্নার পরে টেক্সচারও একে অনন্য করে তোলে। মূলত এই সম্মেলন আয়োজন করে ত্রিপুরা স্টেট অর্গানিক ফার্মিং ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি, যা রাজ্যের কৃষি দপ্তরের একটি অঙ্গসংগঠন। এজেন্সির প্রধান লক্ষ্য রাজ্যকে আন্তর্জাতিক অর্গানিক পণ্যের মানচিত্রে প্রতিষ্ঠিত করা। সম্মেলনে পণ্য প্রদর্শনী থেকে শুরু করে সরাসরি ব্যবসায়ীক কথাবার্তা, ভবিষ্যৎ অংশীদারিত্ব এবং প্রযুক্তিগত সহযোগিতার নানা রূপরেখা উঠে আসে। বিশেষ উল্লেখযোগ্য হলো, ভারতের অন্যতম খাদ্য বিপণন সংস্থা আমূল-এর সঙ্গে ত্রিপুরা সরকারের সহযোগিতা। ইতিমধ্যেই আমূল প্রতিনিধিরা রাজ্যের তিল ও ধনিয়া মরিচ পরীক্ষা করেছেন। জানা গেছে, তারা এই পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজার সম্ভাবন নিয়ে যথেষ্ট আশাবাদী। খুব শীঘ্রই এই সংস্থার সঙ্গে রাজ্য সরকারের চুক্তি স্বাক্ষর হতে চলেছে।
সম্মেলনে মন্ত্রী রতনলাল নাথ জানান, আমরা শুধু ফসল ফলাচ্ছি না, আমরা কৃষিকে সম্মানের পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করছি। ত্রিপুরাকে গড়ে তুলছি অর্গানিক কৃষির এক প্রতীকী রাজ্য হিসেবে। তিনি অর্গানিক চাষকে কোনো ‘ফ্যাশন’ নয়, বরং ‘ভবিষ্যতের টেকসই সমাধান’ বলে ঘোষণা করেন। পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং মৃত্তিকার স্বাস্থ্য রক্ষায় অর্গানিক চাষকেই একমাত্র বিকল্প হিসেবে তুলে ধরেন। ত্রিপুরা আজ উত্তর-পূর্ব ভারতের মধ্যে অর্গানিক কৃষিতে এক প্রতিযোগিতামূলক স্থানে পৌঁছেছে। যেখানে আসাম বা মেঘালয় এখনও সীমিত পর্যায়ে পা ফেলেছে, সেখানে ত্রিপুরা নিজেদের কৃষিপণ্য রপ্তানি এবং বাজার সংযোগের মাধ্যমে অনেকটা এগিয়ে গেছে। এই সম্মেলনের মধ্য দিয়ে তা আরও একবার প্রমাণিত হলো। মন্ত্রী জানান, ভারতীয় অর্গানিক বাজারে বর্তমানে ৭.৩ মিলিয়ন হেক্টর জমি ন্যাশনাল প্রোগ্রাম ফর অর্গানিক প্রোডাকশনের অধীনে নিবন্ধিত, যার মধ্যে ত্রিপুরা উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছে। দেশের মোট অর্গানিক উৎপাদন ৬.৩ মিলিয়ন মেট্রিক টন এবং রপ্তানি ২.৬১ লক্ষ মেট্রিক টন-যার বাজারমূল্য প্রায় ৪,০০৭ কোটি টাকা। এই প্রেক্ষাপটে ত্রিপুরার অবদান আরও তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ এখানকার ছোট ছোট কৃষক, যারা অনেকেই প্রান্তিক, তারা এখন আন্তর্জাতিক মানের পণ্য চাষে দক্ষতা অর্জন করছেন। তাই রাজ্যের কৃষকরাও এখন অনেক বেশি উৎসাহ নিয়ে কাজ করছেন বলে দাবি করেন মন্ত্রী রতনলাল নাথ।