December 11, 2025

মুখোসের আড়ালে

 মুখোসের আড়ালে

শাংহাইতে এসসিও বৈঠকের সম্ভাব, করমর্দন আর কূটনৈতিক হাসির মধ্যেই বেজিং যে আবার পুরানো তাস খেলেছে; তা অরুণাচল প্রদেশকে ‘জাংনান’ বলে নিজেদের বলে দাবি মোটেও বিস্ময়কর নয়। বিস্ময়কর হলো,২০২৫ সালেও চিন এই ক্লান্ত, অচল ও ইতিহাস-অস্বীকারী অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে, অথচ একই সঙ্গে ভারতকে কৌশলগত সহযোগী হিসেবে পাশে টানতে চাইছে। দ্বিচারিতা যদি কোনও রাষ্ট্রের কূটনৈতিক নীতি হয়, তবে তার সবচেয়ে উজ্জ্বল উদাহরণ আজকের বেজিং।
অরুণাচলের তরুণী পেমা ওয়াংজম থংডককে গত ২১ নভেম্বর শাংহাই বিমানবন্দরে হেনস্থা করা তাই কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় এটি রাষ্ট্র-অনুমোদিত মনোভাবের প্রতিফলন।এমন অনভিপ্রেত ঘটনার পরেও চিনা বিদেশ মন্ত্রকের ঢালাও মন্তব্য ‘জাংনান আমাদের দেশের অংশ’ – এ যেন ইচ্ছাকৃত উস্কানি। ভারত যথার্থই বলেছে, এমন আচরণ আস্থা তৈরির প্রচেষ্টাকে ধাক্কা দেয়। শুধু ধাক্কাই দেয় না, বরং সরাসরি ইঙ্গিত করে যে বেজিং কথায় সম্পর্ক চায়, কাজে চাপ সৃষ্টি করে; আলোচনার টেবিলে হাত বাড়ায়, মাঠে পেশী দেখায়; বন্ধুত্বের বার্তা দেয়, সীমান্তে বাস্তবতার বিপরীত ছবি আঁকে। একজন পর্যটককে বিমানবন্দরে হেনস্থা থেকে শুরু করে মানচিত্র-রাজনীতির আগ্রাসন; এসবই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে বিষিয়ে তোলে। বন্ধুত্ব তখনই টেকে, যখন দুই পক্ষ সমানভাবে দায়িত্বশীল হয়। বেজিং যদি সত্যি সম্পর্ক চায়, তাহলে প্রথম শর্ত – ভারতের ভূখণ্ডকে নিয়ে কল্পনার খেলা তাদের বন্ধ করতে হবে।
ভারত-চিন বিশেষ প্রতিনিধি স্তরের সীমান্ত আলোচনাও এর ধাক্কা থেকে রেহাই পাবে না। নরেন্দ্র মোদি সরকারের ‘আর্লি হার্ভেস্ট’ নীতি (মূলত তিনটি সেক্টর যেমন পশ্চিমে লাদাখ, মধ্য-ভাগে উত্তরাখণ্ড ও হিমাচল ও পূর্বের সিকিম, অরুণাচলপ্রদেশ) যেখানে সহজ সেক্টরগুলিতে যেখানে পরিস্থিতি সহজ, সেখানে আগে ‘ফসল কাটা হবে’ অর্থাৎ সীমান্ত নির্ধারণ করা হবে; তাও প্রশ্নের মুখে পড়েছে। কারণ আলোচনা তখনই ফলপ্রসূ হয়, যখন উভয় পক্ষ ন্যূনতম আন্তরিকতা দেখায়। চিনের সাম্প্রতিক পদক্ষেপ সেই আন্তরিকতাকে চ্যালেঞ্জ করেছে। সীমান্তে স্থিতাবস্থা, শান্তি, সহযোগিতা – সবকিছু তখনই অর্থপূর্ণ, যখন উভয় পক্ষ ন্যূনতম আন্তরিকতা দেখায়। কিন্তু অরুণাচল নিয়ে চিনের ধারাবাহিক দাবি স্পষ্ট করে দেয়, এই আন্তরিকতা একতরফা হলে চলবে না। ভারতের উদ্বেগ তাই অমূলক নয়। ভূরাজনীতি আজ এমন অবস্থায় দাঁড়িয়েছে, যেখানে চিন আমেরিকার মোকাবিলায় ভারতের কাঁধ চাইছে, আবার একই সময়ে ভারতের সার্বভৌমত্বে কামড় বসানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এমন দ্বৈত আচরণের জবাব কূটনৈতিক সৌজন্যে সম্ভব নয় – এর জবাব প্রয়োজন দৃঢ়তা, স্পষ্ট বার্তা এবং সীমান্ত নীতিতে নির্ভীক অবস্থান। ভারতের উচিত পরিষ্কার জানিয়ে দেওয়া: অরুণাচল প্রদেশ কোনও আলোচনার বিষয় নয়, কোনও ‘কনটেস্টেড জোন’ নয়- এটি ভারতের অবিচ্ছেদ্য ভূখণ্ড। যে কোনও ধরনের হেনস্থা, দাবি বা মানচিত্র-রাজনীতি সোজাসুজি সম্পর্কের ভিত্তিকে আঘাত করে। যদি বেজিং সম্পর্ক চায়, তবে তাকে প্রথমেই এই বাস্তবতা স্বীকার করতে হবে।
বেজিংয়ের আচরণ যে দিল্লীকে অস্বস্তিতে ফেলেছে, তা শুধু কূটনৈতিক সূত্র নয় – – সরকারী বিবৃতিতেই প্রতিফলিত। ভারতের বিদেশ মন্ত্রক স্পষ্ট বলেছে একজন ভারতীয় নাগরিককে নিয়ে চিন যেভাবে আচরণ করেছে, তা কোনওভাবেই সম্পর্ক এগোনোর পক্ষে সহায়ক নয়। বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল যথার্থই বলেছেন, ‘অরুণাচল প্রদেশের বাসিন্দা ভারতীয় নাগরিককে নিয়ে চিন যা করেছে, তা সম্পর্কের অগ্রগতির জন্য একেবারেই সহায়ক নয়। বিশেষত যখন উভয় রাষ্ট্রই পারস্পরিক আস্থা-সমঝোতা বাড়াতে এবং সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চেষ্টা করছে।’ বস্তুত এই বার্তাই বেজিংকে বুঝিয়ে দেয়, ভারত আর নীরব থাকবে না।
মাস দুয়েক আগে শাংহাইতে এসসিও শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে তিয়ানজিনে মুখোমুখি বৈঠকে বসেছিলেন ভারত ও চিনের দুই রাষ্ট্রপ্রধান; মোদি ও জিনপিং। দুই প্রতিবেশী দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের করমর্দনের ছবি প্রকাশিত হয়েছিল বিশ্ব-সংবাদমাধ্যমে। কিন্তু তারপরেও ভারতের প্রতি বেজিংয়ের এমন উস্কানিমূলক মন্তব্য শুধু অশোভনই নয়, শিষ্টাচার বিরোধীও বটে। কূটনীতিতে শিষ্টাচার প্রয়োজন – কিন্তু নিজের সীমান্ত, নিজের নাগরিক, নিজের ভূখণ্ডের সম্মান রক্ষায় আপোশের কোনও স্থান নেই। ভারতের উচিত এখনই স্পষ্ট করে দেওয়া; সদ্ভাব যদি একতরফা হয়, তবে তার নাম সম্পর্ক নয়- তার নাম প্রতারণা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *