October 27, 2025

ভোট নয়, ছট উৎসবে মেতেছে বিহার!!

 ভোট নয়, ছট উৎসবে মেতেছে বিহার!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-গতকাল অর্থাৎ ২৪ অক্টোবর বিকেলে কোলকাতার হাওড়া স্টেশন থেকে পাটনাগামী বন্দে ভারত এক্সপ্রেসে চাপার পরই ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছিল সবকিছু। এরপর ট্রেন যত এগিয়েছে, চলার পথে বিহারবাসী সহযাত্রীদের আলাপচারিতায় কান পাতার চেষ্টা করে গেছি। বোঝার চেষ্টা করেছি, তাদের আলোচনা বা কথাবার্তার মধ্যে বিহারের রাজনীতি বা নির্বাচনের কোনোও প্রসঙ্গ আছে কিনা। বলতে দ্বিধা নেই, এ ব্যাপারে পুরোপুরি হতাশ হয়েছি বলা যায়। অনেকেই পরস্পরের সাথে, পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলছেন ঠিকই, কিন্তু সেই কথাবার্তার মধ্যে কোথাও রাজনীতি বা বিহার নির্বাচন নিয়ে একটি শব্দও নেই। চলার পথে দুই-তিনজনের সাথে যেচে কথা বলার চেষ্টা করেছি। নিজে থেকেই বিহারের ভোট নিয়ে মতামত জানতে চাইছিলাম। এক্ষেত্রেও হতাশ হতে হলো। বুঝতে পারলাম রাজনীতি এবং বিহার ভোট নিয়ে তাদের হয়তো এতটা মাথাব্যথা বা উৎসাহ নেই। বগির প্রায় পঁচানব্বই শতাংশ যাত্রীকে দেখলাম সারাক্ষণ মোবাইলে মুখ গুঁজে রাখতে। এদিন প্রায় ত্রিশ মিনিট দেরিতে রাত সোয়া এগারোটায় পাটনা স্টেশনে পৌঁছালো বন্দে ভারত এক্সপ্রেস। স্টেশনে নেমেই দেখলাম অন্য ছবি। চারদিকে লোকে লোকারণ্য। কোথাও পা রাখার জায়গা নেই। এমন পরিস্থিতি। ট্রেন থেকে নেমে ট্রলি নিয়ে হেঁটে বাইরে আসেতই অবস্থা কাহিল হয়ে গেছে। ভিড়ে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়েই ছিলাম। পিছন থেকে ভিড় ঠেলতে ঠেলতে বাইরে নিয়ে এলো। স্টেশনের বাইরে পরিস্থিতি আরও ভয়ানক।
বিহারে আজ থেকে শুরু হয়েছে ঐতিহ্যবাহী ছট পুজো ও উৎসব। চলবে আগামী ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত। এটাই বিহারবাসীর সবথেকে বড় উৎসব বা পার্বণ। আমাদের বাঙালিদের শারদোৎসব যেমন, বিহারিদের ছট উৎসবও তেমন জাঁকজমকপূর্ণ। ট্রেন থেকেই দেখা যাচ্ছিল গোটা বিহার আলোকমালায় সেজে উঠেছে। চারদিকে শুধু বাহারি আলোর রোশনাই। এ জন্যই রেল স্টেশনে এত ভিড়। সবাই উৎসবে বাড়িতে ফিরতে উৎসুক হয়ে আছে। খবর নিয়ে জানা গেছে, ২৪ অক্টোবর পাটনা স্টেশন থেকে রাতভর বিহারের বিভিন্ন জেলায় অতিরিক্ত ট্রেন চালানো হয়েছে। প্রত্যেকেই যাতে একেবারে শেষসময়ে হলেও বাড়িতে পৌঁছতে পারে, উৎসবের এই ক’টা দিন যাতে পরিবারের সকলের সাথে কাটাতে পারে। ফলে গোটা বিহার এখন ভোেট নয়, ঐতিহ্যবাহী ছট উৎসবে মেতে আছে। সেটা গতকাল হাওড়া স্টেশন থেকে পাটনাগামী বন্দে ভারত এক্সপ্রেসে পা রাখতেই কিছুটা হলেও অনুভব করতে পারছিলাম। রাতে পাটনা স্টেশনে নামতেই ধারণাটা আরও স্পষ্ট হয়ে গেছে। ভোটের উত্তাপ তো দূরের কথা, আর ক’দিন বাদেই এখানে বিধানসভার হাইভোল্টেজ নির্বাচন হবে, সেটাও বোঝার কোনও উপায় নেই। কোথাও কোনও দলের ফ্ল্যাগ, পোস্টার, প্রচারসজ্জার চিহ্নমাত্র নেই। এক্ষেত্রে বিহারবাসী আমাদের থেকে অনেকটাই এগিয়ে রয়েছে, একথা হলফ করে বলতে পারি।
তাই বলে কি বিহারবাসী রাজনৈতিক সচেতন নয়? অবশ্যই সচেতন। বরং আমাদের চাইতে কয়েক কদম এগিয়ে রয়েছে এবং এগিয়ে গেছে। রাজনীতি নিয়ে হিংসা, প্রতিহিংসা, সন্ত্রাস, অগ্নিসংযোগ, মারপিট, বুথদখল, বন্দুকরাজ-এসবকে পিছনে ফেলে বিহার এখন অনেকটা এগিয়ে গেছে। বিহারে এসব এখন অতীত। কিন্তু আমরা আজও রাজনীতিকে কেন্দ্র করে হিংসা ও সন্ত্রাসকে আগলে ধরে বসে আছি। বিহার পারলেও আমরাআজও এই অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে পারেনি। এখানেও হাজারো সমস্যা আছে। উন্নয়ন, আইনশৃঙ্খলা, বেকারত্ব, পরিযায়ী, শ্রমিক, শিক্ষা ব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। অনেক অভিযোগ, অনুযোগ আছে। কিন্তু কোথাও রাজনীতি ও বিহার নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মারপিট, হানাহানি, হিংসা-প্রতিহিংসা নেই। যে যার মতো করে প্রচার করছে। ২৫ অক্টোবর সকাল থেকে দিনভর পাটনা শহরে বিভিন্ন স্তরের সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলে বিহারে ভোটের উত্তাপ এবং জনগণের আবেগ, তাদের মনোভাব, কী ভাবছেন বিহারবাসী, ইত্যাদি কিছুটা বোঝার চেষ্টা করলাম। তাতে যতটুকু আভাস পাওয়া গেছে, তাতে এটুকু বলতে পারি যে, বাইরে থেকে একাংশ প্রচারমাধ্যমে বিহারের বিধানসভা নির্বাচন কেন্দ্র করে এখন পর্যন্ত যেসব খবর প্রকাশিত হয়েছে, তার সাথে বাস্তবের অনেকটাই ফারাক রয়েছে। ত্রিপুরা থেকে যখন বিহারের উদ্দেশে রওয়ানা হয়েছিলাম, তখন এবারের বিহারের রাজনীতি ও বিহার ভোটের নতুন তারকা, নতুন দলের নতুন নেতা প্রশান্ত কিশোরকেকে নিয়ে মনের মধ্যে একটা পৃথক ভাবনা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু পাটনায় এসে আমজনতার সাথে কথা বলার পর প্রশান্ত কিশোর কে তৈরি হওয়া ভাবনা কোথাও যেন একটু হলেও ধাক্কা খেয়ে গেল। কেন এমনটা হলো, তার ছোট্ট একটা উদাহরণ তুলে ধরলে বিষয়টি হয়তো একটু স্পষ্ট হবে। পাটনায় যে হোটেলে আছি, তারই নীচে রাস্তায় দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিলাম। এমন সময় সাইকেল নিয়ে বিভিন্ন খবরের কাগজ নিয়ে সেখানে হাজির হলেন একজন বয়স্ক পত্রিকা হকার। বয়স কম করে পঁয়ষট্টির উপর হবে। চুল পেকে গেলেও এখনও শরীর পুরোপুরি ফিট। স্বাভাবিকভাবেই পত্রিকা কেনার জন্য ভদ্রলোকের সাইকেলের দিকে এগিয়ে গেলাম। একটা পত্রিকা নিলাম। এর মধ্যে তার সাথে কথা শুরু করলাম। কত বছর ধরে এভাবে পত্রিকা বিক্রি করেন? বাড়ি কোথায়?বললেন,পঞ্চাশ বছর ধরে পত্রিকা বিক্রি করেন।বাড়ি দ্বারভাঙ্গা জেলায়।পাটনাতেই দীর্ঘ বছর ধরে আছেন।এভাবে কথা চালাতে চালাতে ইচ্ছে করে আরও কয়েকটি পত্রিকা কিনলাম।যাতে আরও কিছু কথা বলা যায়। ভোটের কথা তুললাম। বললেন, ভোট দেবেন আগামী ৬ নভেম্বর। তাকে এক কাপ জোর করে চা অফার করলাম। চা খেতে খেতে প্রশান্ত কিশোরের প্রসঙ্গ আসতেই ওই হকার ভদ্রলোক বলেন,ও(পিকে) অরবিন্দ কেজরিওয়াল হতে পারবে না।’ কেন? জানতে চাইলে এরপর মিনিট তিনেক যা বললেন, তা ঝানু পোড়খাওয়া রাজনৈতিক নেতাও হার মেনে যাবে। ভদ্রলোক চলে যাওয়ার পর দিনভর তাঁর কথাগুলোরই যেন প্রতিধ্বনি শুনেছি বিভিন্ন জনের মুখে, বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন আঙ্গিকে। আর দিনভর মনে মনে বলে গেছি, কে বলে বিহারবাসী রাজনৈতিক সচেতন নয়! প্রশান্ত কিশোরকে নিয়ে বিহারবাসী কী ভাবছেন, কতটা প্রভাব ফেলতে পারবেন পিকে, কেন তিনি অরবিন্দ কেজরিওয়াল হতে পারবেন না, সব তুলে ধরবো পরবর্তী প্রতিবেদনে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *