ভোট গণভোট!!
বাংলাদেশে ভোট আর গণভোট মিলে নতুন ক্যাচাল তৈরি হয়েছে। সব কয়টি রাজনৈতিক দলের দূরত্ব বাড়ছে ড. ইউনুসের সঙ্গে। জুলাই সনদ কীভাবে বাস্তবায়ন হবে, সেই সুপারিশ ঐকমত্য কমিশন থেকে পাওয়া গেছে। এই সনদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে সংবিধান সংস্কারের বিষয়গুলো। কারণ, সব কটি সংস্কার প্রস্তাবের ব্যাপারে সব রাজনৈতিক দল একমত হতে পারেনি। আবার প্রশ্ন উঠেছে অনির্বাচিত একটি সরকার কিভাবে সংবিধান সংস্কারে জন্য সিদ্ধান্ত নিতে পারে। দেখা গেল জুলাই মাসে শেখ হাসিনার উৎখাতকে যদি বিপ্লব বলতে হয় তাহলে সনদ পাশ করাতেই হয়। এই সনদে যে বিষয়গুলির উল্লেখ রয়েছে সেই গুলি সামনে রেখেই হয়েছে উৎখাত আন্দোলন বা বিপ্লব।
এ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনার পর সনদের জন্য গঠিত ঐক্যবদ্ধ কমিশন যে সংস্কার প্রস্তাব তৈরি করেছে, তার অধিকাংশগুলোতেই রাজনৈতিক দলগুলোর নিজ নিজ ভিন্নমত আছে। সেই ভিন্নমত সহ রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই সনদে সই করেছে। আবার কেউ কেউ এখনও সই করেনি। এই কথা ঠিক যে গণভোটের লক্ষ্যে সব রাজনৈতিক দল একমত হয়েছে। কিন্তু কীভাবে এই সনদ বাস্তবায়ন হবে বা গণভোটের প্রশ্ন কী হবে এবং উত্তর কি হ্যা বা ন্যা দিয়ে হবে কিনা-এর কোনও জবাব আসেনি। ধোঁয়াশা ছিল এবং আছে। একই সঙ্গে এই প্রশ্নও উঠছে যে কমিশনের প্রস্তাব দেশের রাজনীতিতে নতুন সংকটের সূচনা করলো না তো? ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশে গণভোটের সুনির্দিষ্ট প্রশ্নটি হল, ‘আপনি কি জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ এবং ইহার তফসিল-১-এ সন্নিবেশিত সংবিধান সংস্কার সম্পর্কিত খসড়া বিলের প্রস্তাবসমূহের প্রতি আপনার সম্মতি জ্ঞাপন করিতেছেন?
গণভোটের যে প্রশ্ন ঝুঁকিপূর্ণ। দেশের সব মানুষ সংবিধান সংস্কারের ৪৮ টি প্রস্তাব যথাযথভাবে জেনে বুঝে ভোট দেবেন, এমন না-ও হতে পারে। আর কেউ যদি প্রস্তাবগুলোর ব্যাপারে জেনেবুঝেও থাকেন, তা-ও হ্যা বা না দিয়ে জবাব সম্ভব না। এমন মানুষ কমই পাওয়া যাবে যারা সবগুলি সংস্কারকে হ্যা বলবেন বা না বলবেন। ফলে বাংলাদেশে এখন কথা উঠেছে ভোটের আগে গণভোট অনির্বাচিত সরকারের কম্ম নয়। এর চেয়ে আগামী সংসদকে জুলাই সনদের ভিত্তিতে সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা দেওয়াই সবচেয়ে যৌক্তিক। গণভোটের প্রশ্নটি সেভাবে সাজানো যেত। বলে রাখা দরকার গণভোট যদি হতেই হয় তাহলে গণভোটটি হওয়া উচিত জুলাই সনদের যে বিষয়গুলোয় সব রাজনৈতিক দল একমত হয়েছে, তার ওপর এবং একটি প্রশ্নের ভিত্তিতে।
বিএনপি জাতীয় নির্বাচনে জিতে যাওয়ার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী। তারা যদি জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করতে না চায়, গণভোটে বিএনপি এবং এর সমর্থকদের অবস্থান কী হবে? তারা কি জুলাই সনদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে? গণভোট নিয়ে রাজনীতিতে এরই মধ্যে বিভক্তি ও অনৈক্যের সুর বেজে উঠতে শুরু করেছে। সেই সঙ্গে জনমনেও তৈরি হচ্ছে বিভ্রান্তি। জানা যায়, জুলাই সনদে সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাব আছে ৪৮ টি। এর মধ্যে অন্তত ৩৬ টি প্রস্তাব নিয়ে কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের ভিন্নমত আছে। জুলাই সনদে সেই ভিন্নমতগুলো যুক্ত করে এটা নিশ্চিত করা হয়েছিল যে কোনো রাজনৈতিক দল তাদের নির্বাচনি ইশতেহারে ভিন্নমতগুলো উল্লেখ করে যদি জনগণের ভোটে বিজীয় হয়, তবে তারা তাদের মতো করে সংবিধান সংশোধন করতে পারবে।
সংবিধান সংশোধনের কোনো ইস্যুতে জোরালো আপত্তি আছে এবং সেই ইস্যুতে ভিন্নমত জানানো কোনো দল যদি জাতীয় নির্বাচনে জিতে আসে, সেই দলটিকে কি পুরো সনদ বাস্তবায়নে আদৌ বাধ্য করা যাবে? দলটি তো বলতে পারে যে সংবিধান সংশোধন প্রশ্নে দলের অবস্থান জাতীয় নির্বাচনের আগেই তারা পরিস্কার করেছে। জনগণ যদি সেই দলকে নির্বাচিত করে, তাহলে তারা কেন তাদের ঘোষিত অবস্থান অনুযায়ী সংবিধান সংশোধন করার সুযোগ পাবে না? আবার বিএনপি যদি ক্ষমতায় আসে এবং তারা সনদের যে অধিকাংশ প্রস্তাবে আপত্তি জানাচ্ছে সেইগুলি তো তারা কোনদিনই কার্যকর করবে না। মানে দেশের সংবিধান সংশোধন সর্বাত্মক হবে না।
সোজা কথায়, ইউনুস সরকার পন্থী দল বা জামাত ও তার প্রভাবিত দলগুলি বাংলাদেশের সত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ছোঁয়া লাগানো সংবিধান রাখতে চায় না। তুলনায় বিএনপি এতো বড় পরিবর্তনে পক্ষপাতী নয়। বিএনপিরও প্রভাবিত অনেকগুলি দল আছে। তারা কেউ চায় না। তারা তাদের নির্বাচনি প্রতিশ্রুতিতেও সেই সব কথা তুলে ধরছেন। অন্যদিকে হাসিনা সরকারের উৎখাতের পর যে ডানপন্থী জামাত হেফাজতেরীখন রমরমা চলছে তার একাধারে যেমন সংবিধান পরিবর্তনের পক্ষে তেমনি বর্তমান সংবিধান মেনেই সব করতে হবে এমন বিষয়ের পক্ষপাতী তারা না। তারা সংবিধান তোয়াক্কা করছে না। তারা চাইছে দেশে একটি নতুন সংবিধান তৈরি হোক বা হবে ইসলামপন্থী।
কিন্তু তারাই আবার শেষ কথা বলছে না। সাধারণ নির্বাচনের পক্ষে দেশের সিংহভাগ মানুষ। তারা চান একটা নির্বাচিত সরকার আসুক। সেই সরকার গতানুগতিকে ধারায় হোক বা অন্য ধারায়, দেশের মানুষের অভাব অভিযোগ পূরণ করুক। কিন্তু ফেব্রুয়ারীতে যত এগোচ্ছে ততই বাড়ছে জটিলতা। মানুষ আজও বুঝে উঠতে পারছেন না, গণভোট খায় না মাথায় দেয়।