ভোজসভার ভোজবাজি!!

হোয়াইট হাউসে দ্বিপ্রাহরিক ভোজে অংশ নিতে গিয়েছিলেন পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনির।সেখানে তার দেশের সরকারের তরফে নোবেল কমিটিতে পাঠানো সুপারিশের চিঠিটি ট্রাম্পের হাতে তুলে দিয়েছিলেন উপহারস্বরূপ। ট্রাম্প খুশিও হয়েছিলেন বেদম।
গত সপ্তাহে নৈশভোজের আমন্ত্রণে হোয়াইট হাউসে গিয়েছিলেন ইজরায়েলের রাষ্ট্রপ্রধান নেতানিয়াহু। ভোজ শুরুর মুখে নাকি যথেষ্ট নাটকীয় ভঙ্গিতে নেতানিয়াহু পকেট থেকে একটি চিঠি বের করে ট্রাম্পকে দেন। নোবেল কমিটিকে তার সরকারের লেখা সুপারিশপত্রের প্রতিলিপি ছিল সেই চিঠি। জানা গেছে, চিঠি হাতে নিয়ে যথেষ্ট বিস্মিত হয়েছেন ট্রাম্প, আবার খুশিও হন। এই বছর বিশ্বশান্তির জন্য ট্রাম্পের জন্য নোবেল পুরস্কার কমিটির কাছে দুটি দেশের তরফে সুপারিশ গেল। যদিও ২০২৫ সালে শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কারের সুপারিশ জমার শেষ সময়সীমা ছিল ফেব্রুয়ারী। অতএব এ বছর তো নোবেল পুরস্কার ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্য শিকেয় চড়েছে। সবই বুঝি ভোজসভার ভোজবাজি!
প্রশ্ন আসে শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার কারা পেতে পারেন- সে সম্পর্কে নোবেল কমিটির মানদণ্ড কী, বাস্তবে মানদণ্ড কী হওয়া উচিত!
নোবেল কমিটির নীতিমালা অনুযায়ী, যেসব ব্যক্তি বা সংগঠন বিভিন্ন দেশের মধ্যে বন্ধুত্ব তৈরিতে, বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে সেনাবাহিনী অপসারণে অথবা শান্তি প্রক্রিয়া, শান্তিচুক্তির ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখেন, তারাই এই পুরস্কারের জন্য মনোনীত হবেন। মনোনয়ন করতে পারেন কোনো রাষ্ট্রপ্রধান, মন্ত্রী, শীর্ষস্থানীয় বিচারক। এর বাইরে নোবেল কমিটির অনুমোদিত লোকজন রয়েছে বিশ্বের নানা দেশে। রয়েছে বেশ কিছু সংস্থা, যারা পুরস্কারের জন্য অনুমোদন পাঠাতে পারেন। প্রশ্ন আসে টাম্প কি তার দুই দফার কোনো সময়ে এই ধরনের কোনো একটি কাজ করেছেন? দ্বিতীয় দফায় আমেরিকার রাষ্ট্রপতি হয়ে আসার জন্য তার তিনটি অন্যতম প্রতিশ্রুতি ছিল ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তির পুনর্নবীকরণ, গাজা সমস্যার সমাধান এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ অবসান ঘটানো।কিন্তু এই তিনটির কোনোটাই এখনো অবধি করে উঠতে পারেননি ট্রাম্প। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনকে ‘মাই গুড ফ্রেন্ড’ বলে প্রকাশ্যে জাহির করলেও রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র হামলা কিছুমাত্র বন্ধ হয়নি। এখনও কাতারে মানুষ মরছে ইউক্রেনে। গাজায় এখনও গণহত্যা, সংহার চালিয়ে যাচ্ছে ইজরায়েল। বাকি রইল রাশিয়া। তাদের পরমাণু ক্ষেত্রে টন টন বোমা ফেলার পর তাদের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি নবীকরণের কথা এই মুহূর্তেই ভাবা যাচ্ছে না। তারপরও কেন ভাবা হবে, নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য ডোনাল্ড ট্রাম্প একজন যোগ্য প্রার্থী? গোটা বিশ্ব জানে ভারত-পাকিস্তানের যে যুদ্ধ তা ডোনাল্ড ট্রাম্পের হস্তক্ষেপে শেষ হয়েছে। ভারত এই যুদ্ধে বেশ ভালো অবস্থানেই ছিল। পাকিস্তান সেই কৃতজ্ঞতা থেকেই নোবেল কমিটিতে ট্রাম্পের নাম সুপারিশ করেছে। অন্যদিকে ইজরায়েলের সঙ্গে ইরানের হামলায় ইজরায়েল তেহরানে সামরিক ক্ষেত্র, পরমাণু গবেষণা ক্ষেত্রগুলিকে বিমান হামলার লক্ষ্য বানিয়েছে বটে, বিপরীতে ইরান বেছে বেছে তার ক্ষেপণাস্ত্র পাঠিয়েছে ইজরায়েলের অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ক্ষেত্রগুলিতে। ফলে অর্থনৈতিকভাবে ইজরায়েল অভাবনীয় হুমকির সম্মুখীন। তাদের দেশের ৭০ শতাংশ মানুষ, যারা কাজের সন্ধানে রয়েছেন – তারা আজ দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। এই পরিস্থিতিতে আমেরিকার আর্থিক, সামরিক সহায়তাই নেতানিয়াহুর সামনে একমাত্র পথ।
ট্রাম্প বিশ্বের যে জটিল সমস্যাগুলি সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সেগুলি বাস্তবায়ন করতে গেলে প্রয়োজন আলাপ আলোচনার। কিন্তু সেই ধরনের লোক নন ডোনাল্ড ট্রাম্প। কেউ কেউ মনে করেন ট্রাম্প যাতে অর্থপূর্ণ আলোচনার পথে এগিয়ে যান সেজন্য তার সামনে নোবেল পুরস্কারের মুলো-গাজর ঝোলানো হয়েছে। অন্যদিকে আর এক ধরনের লোকজন ট্রাম্পের কাছ থেকে সুবিধা আদায়ের জন্য তাকে বিশ্বশান্তির প্রবক্তা হিসাবে তুলে ধরে নাচানাচি করতে শুরু করেছেন। নেতানিয়াহু যে ভোজসভায় পকেট থেকে চিঠি বের করে ট্রাম্পের নাকের সামনে ধরলেন, এর মাত্র আড়াই-তিন সপ্তাহ আগে ট্রাম্প বিনাপ্ররোচনায় ইরানের পরমাণু ক্ষেত্রে ত্রিশ হাজার পাউন্ডের বোমা বর্ষণ করে বসলেন। অথচ ইরানের সঙ্গে তার কোনো বিবাদ ছিল না, বরং পরমাণু চুক্তি নবীকরণ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে সন্তোষজনক আলোচনাই চলছিল। এরই মধ্যে বোমাবাজি করে দিলেন। বোমা ফেলে ট্রাম্প সগর্বে ঘোষণা দিলেন, ইরানের পরমাণু ক্ষেত্রগুলি গুঁড়িয়ে দেওয়া গেছে। এককথায় আজ তারাই এহেন ট্রাম্পের জন্য শান্তি পুরস্কার চাইছেন যারা ট্রাম্পকে তৈলমর্দন করে সুযোগসুবিধা আদায় করতে চাইছেন।
প্রসঙ্গত, আমেরিকার প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ওবামা ২০০৯ সালে রাষ্ট্রপতি হয়েই নোবেল পুরস্কার পান। সে সময় থেকেই নোবেল পাওয়ার পথ চেয়ে চেয়ে উদ্গ্রীব হয়েছিলেন ট্রাম্প। ২০১৭ সালে প্রথমবার প্রেসিডেন্ট হয়ে ট্রাম্প নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য অনেককেই ধরাধরি করার ইতিহাস রচনা করেছেন। তার অনুরোধে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে নাকি পাঁচ পাতার চিঠি লিখে নোবেল কমিটিকে সুপারিশ করেছিলেন। সেই চিঠিকে ট্রাম্প প্রকাশ্য সভায় জীবনের সেরা উপহার বলেছেন। কিন্তু নোবেল তার ভাগ্যে জোটেনি। এবার কি ভাগ্য বদলাবে?আপাতত সেই লক্ষণ কিন্তু দেখা যাচ্ছে না। নোবেল কমিটি যে ট্রাম্পের নাম শান্তিদূত হিসাবে মেনে নেবে না, সেই আশঙ্কা ট্রাম্পের নিজেরও রয়েছে। নোবেল নিয়ে ট্রাম্পের মনোকষ্ট গোপন কিছু নয়। ২০২০ সালে ট্রাম্প প্রকাশ্য সভায় আক্ষেপ করেছেন, তার নাম যদি হতো ওবামা তাহলে চোখের পলকেই নোবেল পেতে পারতেন। নোবেল কমিটির লিবারালরা তার নাম কখনোই মেনে নেবে না।
এদিকে দিন যত যাচ্ছে ট্রাম্পকে নিয়ে ঘরের ভেতরেই বেড়ে চলেছে সমালোচনা। ইউরোপিয় দেশগুলি ট্রাম্পের কাণ্ডকীর্তিতে উদ্বিগ্ন হয়ে তাকে খুশি রাখতে নানারকম চাতুরির আশ্রয় নিচ্ছেন। ওই দুনিয়ার রাজনৈতিক পণ্ডিতেরা ট্রাম্পের কাজকর্মকে পাগলামি বলে মন্তব্য করে উপহাস করতে শুরু করেছেন। ট্রাম্পের ‘ব্যক্তিগত কূটনীতি’ সম্পর্কে দেশের ভেতরেও রয়েছে অসন্তোষ। বলা হচ্ছে তারাও চাইছেন ট্রাম্প তার স্বভাবসুলভ ‘পাগলামি’র পথ ছেড়ে অর্থপূর্ণ আলাপ আলোচনার পথে ফিরে আসুন। হয়তো তারাই তার সামনে বেশি করে রাখতে চান নোবেল জয়ের ‘মুলো-গাজর’!
