ভারতাত্মার জয়!!
             
      আনন্দে ভাসছে গোটা দেশ।বিস্ময়াবিষ্ট বিশ্ব।অর্ধেক আকাশ নয়,গোটা আকাশজুড়ে আজ বিজয় আর উচ্ছ্বাসের আতসবাজি।এক স্বপ্নের জয় এনে দিয়েছে হরমনপ্রীত কৌর, স্মৃতি মান্ধানা,শেফালি বর্মা, দীপ্তি শর্মারা। সোনার মেয়ে এরা।বিশ্বকাপ জেতা ভারতীয় মহিলা দলকে আইসিসি দিয়েছে ৫৪ কোটি, বিসিসিআই দিচ্ছে ৭০ কোটি। এবারের বিশ্বকাপে মোট প্রাইজমানি ছিল ১৬৮ কোটি ১৫ লক্ষ টাকা, যা মেয়েদের যেকোনো আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ। ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দলের জন্য সময়টা এখন বিশেষ, একই সঙ্গে ঐতিহাসিকও। রবিবার মাঝরাতে নবি মুম্বাইয়ের ডিওয়াই পাতিল স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ৫২ রানে হারিয়ে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন ভারতের মেয়েরা। ভারতীয় দল একাধিকবার ক্রিকেটে বিশ্বজয় করেছে। তবে মেয়েদের দল এই প্রথম খেতাব ছিনিয়ে আনলো। সেই দিক থেকে ভারতের ক্রিকেটমোদিদের এক দীর্ঘ প্রত্যাশা পূরণ হল এই ঘটনায়।
বিশ্বকাপ জেতার সুবাদে আইসিসির তরফ থেকে ৪৪ লক্ষ ৮০ হাজার ডলার পেয়েছে হরমনপ্রীতের দল। এরপর ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড (বিসিসিআই) মহিলা দলকে আরও বড় সুখবর দিয়েছে। বোর্ডের সচিব দেবজিৎ সইকিয়া জানিয়েছেন সব মিলিয়ে এক রাতেই প্রায় ১২৫ কোটি টাকা নিশ্চিত হয়েছে মহিলা ক্রিকেটের নতুন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের। সইকিয়া জানিয়েছেন, জয় শাহ বিসিসিআইয়ের দায়িত্ব নেওয়ার পর মহিলা ক্রিকেটে অনেক পরিবর্তন এনেছেন। ছেলে ও মেয়েদের সমান বেতনের (অর্থ পুরস্কার) ব্যবস্থা করা হয়েছে। গত মাসে আইসিসি চেয়ারম্যান জয় শাহ মেয়েদের টুর্নামেন্টের অর্থ পুরস্কার ৩০০% বাড়িয়েছেন। আগে এই পুরস্কার ছিল ২৮ লক্ষ ৮০ হাজার ডলার, এখন তা বাড়িয়ে ১ কোটি ৪০ লক্ষ ডলার করা হয়েছে।এসব পদক্ষের মহিলা ক্রিকেটকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছে। বিসিসিআইও খেলোয়াড়, কোচ, সাপোর্ট স্টাফসহ পুরো দলকে ৫১ কোটি টাকা পুরস্কারের ঘোষণা দিয়েছে।
দেশের প্রান্তে প্রান্তে এই জয় নিয়ে রবিবার রাত থেকেই জয়োচ্ছ্বাস চলছে। সোনার মেয়েরা জয় এনে দিয়েছে। কিন্তু এই ঘটনাটি তো একদিনে ঘটেনি। অনেক লড়াই, অনেক কৃষ্ণসাধন করতে হয়েছে ভারতের মেয়ে ক্রিকেটারদের। গোটা বিশ্বজুড়েই মহিলা ক্রিকেট এখনও এক উন্নাসিকতার শিকার। ভারতীয় ভূখণ্ডে তো আর আলাদা করে বলার অবকাশ নেই।মেয়েদের ক্রিকেট বলে জয়ের উচ্ছ্বাসে কোনও খামতি না থাকলেও এদের দ্বিতীয় শ্রেণীর বা ঘরোয়া ক্রিকেটের মতোই কিছু দুধভাত গোছের প্রতিক্রিয়া দেওয়া লোকের অভাব নেই চারপাশে। যদিও লড়াইটা কী ছিল তা জানার জন্য খেলোয়াড় হবার দরকার পড়ে না। ক্রীড়ামোদি যে কোনও সংবেদী লোক, মাত্রেই বুঝতে পারেন লড়াই কত কঠিন ছিল।
এই অবসরে মাঠের বাইরের খেলা আর মেয়েদের অবস্থা নিয়ে জোরসোর আলোচনা শুরু হয়েছে। হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। কারণ খোদ বিসিসিআইয়ের ভেতর থেকেও ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দল সম্পর্কে প্রতিকূলতার হিমশীতল হাওয়া বইয়ে দেওয়া হয়েছিল নানা সময়ে, যা মেয়েদের হতাশ করতে পারতো। মেয়েরা ঘরোয়া এই লড়াইগুলি করেছে মুখ বুজে। অপমান হজম করেছে মুখ বুজে। তাই এই জয় এক অন্যরকম বিশ্বজয়। কেবল অস্ট্রেলিয়া, সাউথ আফ্রিকার বিরুদ্ধে জয় নয়, এই জয় ঘরের ভেতরকার প্রতিকূলতার বিরুদ্ধেও। বিসিসিআইর প্রেসিডেন্ট শ্রীনিবাসনের মেয়েদের ক্রিকেট খেলা নাপসন্দ ছিলো। ফলে সার্বিক নিরুৎসাহ তার তরফ থেকে ছিল। আজ তিনি প্রেসিডেন্টের পদে নেই, তবে নবি মুম্বাইয়ের মাঠের খেলাটা নিশ্চয়ই দেখেছেন। তার মুখনিঃসৃত একটা প্রতিক্রিয়া দেশ শুনতে চাইবে। ভাগ্যিস বিসিসিআই প্রেসিডেন্ট হননি সৌরভ গাঙ্গুলি। যিনি অবলীলায় বলতে পারেন-ক্রিকেট খেলাটা মেয়েদের জন্য নয়।তবে তার প্রতিক্রিয়া আজকাল ক্রীড়ামোদিদের সেইভাবে আলোড়িত করে না।ক্রিকেটের মাঠের তুলনায় নানান টিভি শপেই বেশি কদর তার।
এক দীর্ঘ লড়াই লড়েছেন ভারতের মেয়ে ক্রিকেটাররা। এই সেদিনও খেলতে গেলে, চর্চায় যেতে হলে হরমনপ্রীত বা স্মৃতি, শেফালিদের প্রথম পুরুষ (নারীরা) ডায়না এডুলজি বা শান্তা রঙ্গস্বামীদের নিজের বিছানাপত্র নিজেরে কাঁধে বয়ে অসংরক্ষিত রেল কামরায় যাতায়াত করতে হয়েছে। সোনার মেয়েরা যারা আজ হাতে বিশ্ব খেতাব ধরেছেন তারা খেলার মাঠে পুরুষদের সাথে সমানাধিকারের দাবি নিয়ে খেলার এক পরিস্থিতি পরিবেশ বানিয়ে নিতে পেরেছিলেন। বোর্ডের ভেতরে প্রতিকূলতা একটা থাকলেও বাইরের ক্রীড়াঙ্গন নিশ্চয়ই তাদের পাশে ছিল, ধরে নিতে হয়। জেমাইয়া, রিচারা মাঠে সেই সম্মান প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন। জয়ের দৃশ্যে দর্শকের আসনে বসে রোহিত শর্মা কাঁদেন, ঝুলন গোস্বামী, মিতালী রাজরা লাফিয়ে ওঠেন যখন সেই দৃশ্য আমাদের বিশাল ভারত দেশের বর্ণনায় সদ্য আসামে নিষিদ্ধ রবীন্দ্রনাথকেই স্মরণ করায়। নানা জাতি নানা মত নানা পরিধান, বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান। জয় ভারতাত্মার জয়।