বৈশালীতে এবার দুই জোটের কঠিন লড়াই!!
অনলাইন প্রতিনিধি :-বিহারের অন্যতম সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যশালী স্থান হচ্ছে বৈশালী।এটি একটি প্রসিদ্ধ জেলা ও শহর। ঐতিহাসিক তথ্য বলছে মহাভারত এবং বৌদ্ধ ও জৈন ইতিহাসে উল্লেখিত প্রাচীন মিথিলা অঞ্চলের বৈশালী শহরের নামে এই জেলার নামকরণ করা হয়েছে। বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মগ্রন্থগুলিতে অসংখ্যবার বৈশালী শহরের উল্লেখ পাওয়া যায়। ইতিহাস বলে মহাবীর বৈশালীতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। গৌতম বুদ্ধ তার শেষ উপদেশ বৈশালীতে প্রদান করেছিলেন এবং এখানেই তাঁর পরিনির্বাণের কথা ঘোষণা, করেছিলেন। বহু লোককথা, বৌদ্ধ সাহিত্যে উল্লিখিত বিশিষ্ট রাজনর্তকী আম্রপালিও এই বৈশালীর অধিবাসী ছিলেন। তিনি গৌতম বুদ্ধের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন।বৈশালী শহর থেকে এক কিলোমিটার দূরে অভিষেক পুষ্করনী অবস্থিত।এই পবিত্র জলাধারের জল বৈশালীর নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অভিষেকের কাজে ব্যবহৃত হয়। আজও নাকি এই পরম্পরা অব্যাহত আছে। আগে বৈশালী ছিলো মুজফফরপুর জেলার অন্তর্ভুক্ত।১৯৭২ সালে মুজফফরপুরকে ভেঙে পৃথক বৈশাখী জেলা গঠন করা হয়।বৈশালী জেলায় রয়েছে তিনটি মহকুমা এবং দুইটি লোকসভা কেন্দ্র। তিনটি মহকুমা হলো হাজিপুর, মাহনার ও মহুয়া। আর দুটি লোকসভা কেন্দ্র হলো বৈশাখি এবং হাজিপুর।এই দুটি লোকসভা কেন্দ্রে রয়েছে মোট আটটি বিধানসভা কেন্দ্র। সেগুলি হলো- হাজিপুর, লালগঞ্জ, বৈশালী, মহুয়া, রাজাপাকের (এসসি), রাঘোপুর, মোহনার এবং পাতেপুর (এসসি)। এই জেলার লোকসংখ্যা আমাদের ত্রিপুরা রাজ্যের লোকসংখ্যা থেকে কিছুটা বেশি। তবে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, ২০০৬ সালে ভারত সরকারের ঘোষিত দেশের ২৫০ টি সর্বাধিক অনগ্রসর জেলার তালিকায় বৈশালী জেলার নামও ছিলো। বর্তমানে এই জেলা অনেকটা এগিয়েছে বলে মনে হলো। বিশেষ করে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন চোখে পড়ার মতো। এই জেলাকে চারটি জাতীয় সড়ক যেমন ১৯,৭৭,১০৩ এবং ৩২২ বৈশালীকে রাজধানী পাটনার আরও অনেক কাছে নিয়ে এসেছে। গান্ধী সেতু, জয়প্রকাশ সেতু সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থাকে আরও সহজ করেছে।জেলায় বসবাসকারী মোট জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় ৯১ শতাংশ হিন্দু, ৮.৫০ শতাংশ মুসলিম এবং ০.৫০ শতাংশ অন্যান্য সম্প্রদায়ের। জেলার সদর দপ্তর হচ্ছে হাজিপুর। বৈশালী জেলার রাজনৈতিক ইতিহাস বড় চমকপ্রদ। এই জেলার অন্তর্ভুক্ত দুটি লোকসভা কেন্দ্রই (হাজিপুর, বৈশালী) মূলত ভারতের জাতীয় রাজনীতির অন্যতম ব্যক্তিত্ব তথা বিহারের লোক জনশক্তি পার্টির প্রয়াত নেতা রামবিলাস পাসোয়ানের গড় বলে পরিচিত। আবার জেলার আটটি বিধানসভা আসনে শাসক-বিরোধী একে অপরকেই বরাবরই টেক্কা দিয়ে চলেছে। হাজিপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে প্রয়াত রামবিলাস পাসোয়ান ১৯৭৭ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত সাতবার সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেযন। ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনেও হাজিপুর কেন্দ্র থেকে জয়ী হয়েছেন এলজেপি প্রার্থী পশুপতি পারস। বর্তমানে (২০২৪) এই হাজিপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে রামবিলাস পাশোয়ানের পুত্র চিরাগ পাসোয়ান সাংসদ নির্বাচিত হয়ে এনডিএ জোটের অন্যতম শরিক ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। অন্যদিকে জেলার অন্তর্ভুক্ত বৈশালী লোকসভা কেন্দ্রটিও গত ২০১৪ সাল থেকে প্রয়াত নেতা রামবিলাস পাসোয়ানের দল লোকজনশক্তি পার্টির দখলে। যদিও বৈশালী লোকসভা কেন্দ্রে এর আগে চারবার লালুপ্রসাদের আরজেডি এবং নীতীশ কুমারের জনতা দল ইউনাইটেড তিনবার জয়ী হয়েছিল। বর্তমানে বৈশালী লোকসভা কেন্দ্রের সাংসদ লোক জনশক্তির পার্টির ভিনা দেবী। তিনি ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনেও এই কেন্দ্র থেকে জয়ী হয়ে সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন।সেইদিক থেকে বিচার করলে বৈশালী জেলা লোক জনশক্তি পাটির গড় বলা যায়।কিন্তু বিধানসভা নির্বাচনের রাজনৈতিক সমীকরণ ও ফলাফলের দিকে তাকালে দেখা যায়, এই জেলার অন্তর্ভুক্ত আটটি বিধানসভা আসনে শাসক-বিরোধী একে অপরকে টেক্কা দিচ্ছে। সর্বশেষ ২০২০ বিধানসভা নির্বাচনে আটটি বিধানসভা আসনের মধ্যে চারটিতে জয়ী হয়েছিল এনডিএ জোটের প্রার্থী, বাকি চারটি আসনে জয়ী হয়েছিল মহাজোটের প্রার্থী। এনডিএ জোটের চারটির মধ্যে বিজেপী জয়ী হয় তিনটি আসনে, একটিতে জেডি (ইউ)। মহাজোটের চারটির মধ্যে আরজেডি জয়ী হয় তিনটি আসনে, একটি আসনে জয়ী হয়েছিল কংগ্রেস। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এই জেলাতেই রয়েছে ১২৮ নং রাঘোপুর বিধানসভা কেন্দ্র। এই বিধানসভাটি আবার লালুপ্রসাদের আরজেডি দলের দুর্গ। এই কেন্দ্র থেকেই লালুপুত্র তেজস্বী যাদব পরপর দুইবার (২০১৫,২০২০) জয়ী হয়েছেন। এইবারও (২০২৫) তিনি এই রাঘোপুর কেন্দ্র থেকে প্রার্থী হয়েছেন। তিনিই মহাজোটের মুখ্যমন্ত্রী মুখ। স্বাভাবিকভাবেই এই কেন্দ্রের নির্বাচনের দিকে শুধু বিহারের জনতাই নয়, গোটা দেশবাসীর নজর থাকবে। এনিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। আবার তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, এই রাঘোপুর বিধানসভা আসনে ২০১০ সালের নির্বাচনে আরজেডি দলের প্রার্থী হয়েছিলেন লালু-পত্না রাবড়ি দেবা। সেই নির্বাচনে রাঘোপুর কেন্দ্রে রাবড়ি দেবী পরাজিত হয়েছিলেন। জয়ী হয়েছিল জনতা দল ইউনাইটেডের সতীশ কুমার।
বর্তমানে এই বৈশালী জেলার আটটি বিধানসভা আসনের মধ্যে হাজিপুর, লালগঞ্জ, পাতেপুর (এসসি) এই তিনটি কেন্দ্র বিজেপির দখলে। জেডিইউ’র দখলে রয়েছে বৈশালী আসনটি। অন্যদিকে মহুয়া, রাঘোপুর, মোহনার এই তিনটি বিধানসভা কেন্দ্র আরজেডির দখলে। কংগ্রেসের দখলে রয়েছে রাজাপার তপশিলি সংরক্ষিত আসনটি। এবার ২০২৫ বিধানসভা নির্বাচনে দুই জোটের আসন বণ্টনে এনডিএ জোটের পক্ষে কোনও সমস্যা না হলেও মহাজোটের আসন বণ্টনে জেলার আটটি বিধানসভা আসনের মধ্যে দুটিতে (বৈশালী, রাজাপাকের) ঐকমত্য গড়ে উঠেনি। এনডিএ জোটের পক্ষে বিজেপি প্রার্থীরা এবার লড়াই করবে হাজিপুর, লালগঞ্জ, রাঘোপুর এবং পাতেপুর (এসসি) এই চারটি কেন্দ্রে। বৈশালী, রাজাপাকের (এসসি), মোহনার এই তিনটি কেন্দ্রে লড়াই করবে।
জেডিইউ প্রার্থী। মহুয়া কেন্দ্রে লড়াই করবে এলজেপি প্রার্থী। এখানে অবাক হওয়ার বিষয় হলো, জেলার দুটি লোকসভা আসন এলজেপির দখলে থাকলেও, জেলার আটটি বিধানসভার মধ্যে মাত্র একটিতে লড়াই করছে এলজেপি প্রার্থী। আবার এটাও ঠিক যে, আটটি বিধানসভার মধ্যে একটিও এলজেপির দখলে নেই। বরং এবার আসন বণ্টনে একটি আসন এলজেপিকে দেওয়া হয়েছে। এই আসনটি জেডিইউ ছেড়ে দিয়েছে। অন্যদিকে, মহাজোটের পক্ষে আরজেডি প্রার্থীরা লড়াই করবে হাজিপুর, লালগঞ্জ, বৈশালী, মহুয়া, রাঘোপুর, মোহনার এবং পাতেপুর-মোট সাতটি আসনে। রাজাপাকের (এসসি) একটি আসনে লড়াই করবে কংগ্রেস। এই আসনটিতে আগেও (২০২০) কংগ্রেস প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। কিন্তু এখানে আবার মহাজোটের অন্য শরিক সিপিআই প্রার্থী দিয়েছে। অপরদিকে বৈশালী আসনটিতে গতবার কংগ্রেস প্রার্থী লড়াই করেছিল। আসন বণ্টনে বৈশালী আসনটি এবার কংগ্রেসকে দেওয়া হয়নি। এটি আরজেডি নিয়ে নিয়েছে। ফলে এখানে ক্ষুল কংগ্রেস প্রার্থীও লড়াইয়ের ময়দানে রয়েছেন।এবার ২০২৫ বিধানসভা নির্বাচনে হাজিপুর বিধানসভা আসনে এনডিএ জোটের বিজেপি প্রার্থী গতবারের জয়ী বিধায়ক বর্ষীয়ান নেতা অবধেশ সিং। দল এবারও তাঁকে এই কেন্দ্রে টিকিট দিয়েছে। অন্যদিকে মহাজোটের গতবারের বিজিত আরজেডি প্রার্থী দেও কুমার চৌরাসিয়া। এবারও দল তার উপরে আস্থা রেখেছে। লালগঞ্জে কেন্দ্রে এনডিএ জোটের বিজেপি প্রার্থী গতবারের জয়ী বিধায়ক সঞ্জয় কুমার সিং। অপরদিকে মহাজোটের আরজেডি প্রার্থী নতুন মুখ শিবানী শুক্লা। গতবার এই আসনটিতে কংগ্রেস প্রার্থী রাকেশ কুমার লড়াই করেছিল। বৈশালী বিধানসভা আসনে এনডিএ জোটের জেডিইউ প্রার্থী গতবারের জয়ী বিধায়ক সিদ্ধার্থ প্যাটেলকে দল এবারও টিকিট দিয়েছে। এই কেন্দ্রে মহাজোটের আসন সমঝোতা হয়নি। গতবার এই কেন্দ্র থেকে কংগ্রেসের টিকিটে লড়াই করেছিলেন সঞ্জীব সিং। তিনি এবারও লড়াই করবেন।
কিন্তু এই কেন্দ্রে মহাজোটের আরজেডি দলও প্রার্থী করেছে নতুন মুখ অজয় কুমার কুশওয়াহা-কে। ফলে জেডিইউ প্রার্থীর জয়ের রাস্তা অনেকটা সহজ হবে বলে মনে করা হচ্ছে। মহুয়া আসনটি এবার এনডিএ জোটের শরিক এলজেপিকে দেওয়া হয়েছে। দলের প্রার্থী নতুন মুখ সঞ্জয় কুমার সিং। অন্যদিকে মহাজোটের গতবারের বিজিত আরজেডি প্রার্থী মুকেশ কুমার রোশন। রাজাপাকের (এসসি) আসনে এনডিএ জোটের গতবারের বিজিত জেডিইউ প্রার্থী মহেন্দ্র রাম। অন্যদিকে এই আসনটিতেও মহাজোটের আসন সমঝোতা হয়নি। গতবার (২০২০) এই কেন্দ্র থেকে জয়ী হয়েছিলেন কংগ্রেসের প্রতিমা কুমারী দাস। কংগ্রেস এই কেন্দ্রে এবারও প্রতিমা কুমারী দাসকে প্রার্থী করেছে। কিন্তু এই কেন্দ্রে আবার লড়াই করছে মহাজোটের আরেক শরিক সিপিআই। এখানে সিপিআই প্রার্থী মোহিত পাসোয়ান। রাঘোপুর কেন্দ্রে মহাজোটের আরজেডি প্রার্থী মুখ্যমন্ত্রী মুখ তেজস্বী যাদব।অন্যদিকে এনডিএ জোটের গতবারের বিজিত বিজেপি প্রার্থী সতীশ কুমার যাদবকে দল এবারও টিকিট দিয়েছে। মোহনার কেন্দ্রে গতবারের জয়ী বিধায়ক আরজেডির বীণা সিং-কে দল এবার টিকিট দেয়নি। এখানে মহাজোটের আরজেডি প্রার্থী নতুন মুখ রবীন্দ্র কুমার সিং। অপরদিকে, এনডিএ জোটের গতবারের বিজিত জেডিইউ প্রার্থী উমেশ সিং কুশওয়াহাকে দল এবারও টিকিট দিয়েছে। পাতেপুর (এসসি) আসনে এনডিএ জোটের প্রার্থী গতবারের জয়ী বিধায়ক বিজেপির লখেন্দ্র কুমার রোশন। অন্যদিকে মহাজোটের আরজেডি প্রার্থী নতুন মুখ প্রেমা চৌধুরী। গতবারের বিজিত প্রার্থী শিবচন্দ্র রামকে দল এবার টিকিট দেয়নি।
এখানে উল্লেখ করার বিষয় হলো, এই সবগুলি কেন্দ্রেই রয়েছে প্রশান্ত কিশোরের নবগঠিত দল জন সুরাজ পার্টির প্রার্থীরা। ফলে এবার লড়াই হবে জমজমাট। লোকসভার ভোটে এই জেলায় এলজেপির আধিপত্য দেখা গেলেও, বিধানসভা ভোটে দেখা গেছে অন্য চিত্র। বলা যায় একেবারে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। এই আটটি বিধানসভা আসনে জয় পরাজয়ের ব্যবধানও খুব একটা বেশি নয়। দুটি আসনে জয়ের ব্যবধান তো ছিলো খুবই কম।ফলে এবার অনেক হিসাব উলটপালট হয়ে যেতে পারে। স্থানীয় মানুষের সাথে কথা বলে কিন্তু এমনই আভাস পাওয়া গেছে। তবে লড়াই যে হাড্ডাহাড্ডি হতে চলেছে, এ নিয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। নজরকাড়া এই জেলায় হাওয়া কোন দিকে অথবা পাল্লাভারী কার- অনুমান করা খুবই মুশকিল। তবে একটা বিষয় স্পষ্ট, পিকে’র জন সুরাজ পার্টির উপরই নির্ভর করছে এনডিএ এবং মহাজোটের ভাগ্য। আগামী ৬ নভেম্বর এই আটটি বিধানসভা কেন্দ্রেও ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।