বিহার কোন পথ দেখায়!!

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অন্যতম উপাচার হলো ভোট।দেশের সব ভোটারদের ভোটাধিকার প্রয়োগের নিশ্চয়তা প্রদান এবং সবগুলি রাজনৈতিক দলকে ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও ভোটের মুখে দলগুলির রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্ম যাতে নিশ্চিত হয় তা দেখার জন্য সংবিধান ক্ষমতা দিয়ে রেখেছে নির্বাচন কমিশনকে। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে এই কাজগুলি কঠিনতম হচ্ছে। নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা এবং তার কাজকর্ম নিয়ে ক্রমাগত প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। ভোটার তালিকা সংশোধন নিয়ে নির্বাচন কমিশনের কাজকর্ম সামনে রেখে টানা সপ্তাহজুড়ে সংসদ অচল হয়ে রইলো। বিরোধীরা হুমকি দিচ্ছে নির্বাচন কমিশনের কাজকর্মে লাগাম টানা না হলে বিরোধীরা বিহার বিধানসভা নির্বাচন বর্জনের রাস্তায় হাঁটতে পারে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচন বয়কটের অর্থ হল প্রচলিত ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন।
এই ঘটনা যদি ঘটে যায় তাহলে এটি দেশের নির্বাচনি ব্যবস্থায় একটা কালো ও স্থায়ী দাগ তৈরি করে দেবে। যার জন্য শুধু নির্বাচন কমিশনই নয়, ভবিষ্যৎ দায়ী করবে অন্যান্য সাংবিধানিক সংস্থাগুলিকেও। দায়ী থাকবে সংসদ, দায়ী থাকবে বিচারব্যবস্থা। এই সময়ে বিহারে নির্বাচন কমিশনের ভোটার তালিকায় যে নিবিড় সংশোধনের কাজ চলছে তা সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণে রয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট কি জানায় সেই দিকে সবার নজর। সংসদ তো অচল। বিরোধীরা একজোট হয়ে বিহারের নিবিড় সংশোধনীর বিরোধিতা করে যাচ্ছে। বিহারের প্রধান বিরোধী শক্তি রাষ্ট্রীয় জনতা দলের নেতা তেজস্বী যাদবই হুঁশিয়ারি দিয়েছেন নির্বাচন কমিশনের কাজকর্মে লাগাম টানা না হলে তার দল ভোট বয়কট করবে। বিরোধী জোটের অন্য শরিকেরা অবশ্য এখনই এ বিষয়ে মনস্থির করতে রাজি নয়। ভোটার তালিকা সংশোধন নিয়ে মামলার রায়ে সুপ্রিম কোর্ট কী বলেন, তা তারা আগে দেখে নিতে চান। বছরের শেষ প্রান্তে অনুষ্ঠিত হবে বিহার বিধানসভার ভোট।
সুপ্রিম কোর্টে ভোটার তালিকা সংশোধন নিয়ে মামলার পরবর্তী শুনানি রয়েছে ২৮ জুলাই। মামলার প্রথম দিনের শুনানিতে প্রকৃত ভোটার নির্ধারণে আধার কার্ড, ভোটার কার্ড ও রেশন কার্ডকে নথি হিসেবে মান্যতা দেওয়ার যে পরামর্শ সুপ্রিম কোর্ট দিয়েছিলেন, ইসি তা নাকচ করে দিয়েছে। সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা পেশ করে ইসি জানিয়েছে, ওই তিন কার্ড নাগরিকত্বের প্রমাণ হিসেবে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। কারণ, অনেক বিদেশিই অবৈধভাবে ওই কার্ড হাসিল করেছে।বিহারে ইসি যে নিবিড় ভোটার তালিকা সংশোধন প্রক্রিয়া চালু করেছে,শুক্রবার ২৫ জুলাই তা শেষ হলো।এই তারিখের মধ্যেই নির্দিষ্ট নথি জমা দিতে হবে। ইসি খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ করবে এক আগষ্ট। সময়সীমা শেষ হওয়ার এক দিন আগে ইসির হিসেবে ৬১ লক্ষ ভোটারের নাম খসড়া তালিকা থেকে বাদ যাচ্ছে। তাদের মধ্যে ২১ লক্ষ ৬০ হাজার নাম রয়েছে মৃত ব্যক্তির, ৩১ লক্ষ ৫০ হাজার রাজ্য ছেড়ে ‘পাকাপাকিভাবে’ অন্যত্র চলে গেছেন এবং ৭ লক্ষের নাম দুই জায়গায় নথিবদ্ধ। ইসির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী আরও এক লক্ষ ভোটারের ‘হদিস’ নেই। রাজ্যে মোট প্রাপ্তবয়স্ক ভোটার রয়েছে ৮ কোটি।
নির্বাচন কমিশন যে পথে এগোচ্ছে তাকে লাগামছাড়া মন্তব্য করে বিরোধীরা ভোট বর্জনের রাস্তায় হাঁটতে পারে বলে আরজেডি নেতা তেজস্বী যাদব প্রথমবার সেই ইঙ্গিত দেন গত বুধবারে। তিনি বলেন,যেভাবে ভোট চুরির রাস্তায় ইসি হাঁটছে, তার প্রতিকার না হলে ভোট বর্জনের কথা ভেবে দেখা যেতে পারে। ইন্ডিয়া জোটের শরিকদের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাবও তিনি দিয়ে রেখেছেন। বৃহস্পতিবার আরও একবার সেই ইঙ্গিত দিয়ে তিনি বলেন, ‘ভোট বর্জন বিকল্প পথ হিসেবে আমরা খোলা রাখছি। সময় এলে সবার সঙ্গে কথা বলে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। কারণ, ভোটার তালিকা সংশোধনের নামে যা চলছে, তা জনগণের সঙ্গে প্রতারণা ছাড়া আর কিছু নয়।’ তেজস্বী ভোট বর্জনের ইঙ্গিত দিলেও কংগ্রেস ও বাম শরিকেরা এখনই ওই বিষয়ে ভাবনাচিন্তা করতে প্রস্তুত নয়। সিপিআই (এমএল) লিবারেশন নেতা দীপঙ্কর ভট্টাচার্য, বিহারের ভারপ্রাপ্ত এআইসিসি নেতা কৃষ্ণ আল্লাবরুসহ অন্যরা সুপ্রিম কোর্টের রায় দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পক্ষে। কংগ্রেস নেতা বলেছেন, তাদের সামনে সব বিকল্পই খোলা আছে। নির্বাচন প্রক্রিয়া নিরপক্ষে না হলে উপযুক্ত বিকল্প বেছে নেওয়া হবে। স্পষ্টতই সুপ্রিম কোর্টের রায় ও ইসির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তারা দেখে নিতে চান। ন্যায় বিচারের আশা ছাড়তে এখনই তারা রাজি নন।
ভোটার তালিকার নিবিড় সংশোধন নিয়ে বিতর্কে প্রথমবার মুখ খুললেন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমার। বৃহস্পতিবার তিনি বলেন, মৃত ও ‘বিদেশি’ ভোটারদের কোন যুক্তিতে ভোটার তালিকায় রেখে দেওয়া হবে তা তার বোধগম্য হচ্ছে না। বৃহস্পতিবার এক গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এই প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, ভোটার তালিকা হলো সফল গণতন্ত্রের ভিত্তি। যদিও বিরোধীরা ভোটার তালিকা সংশোধন নিয়ে আপত্তি একেবারেই তোলেনি। আপত্তি তাদের দুটি ক্ষেত্রে। প্রথমত, রাজ্য বিধানসভার ভোটের মাত্র ছয় মাস আগে এই বিপুল কাজ এত দ্রুত কেন করা হচ্ছে? কেন মাত্র এক মাসের মধ্যে খসড়া ভোটার তালিকা তৈরি করা হচ্ছে? আগে কেনা এই কাজে হাত দেওয়া হয়নি? দ্বিতীয়ত, নাগরিকত্ব প্রমাণের কাজ কেন নির্বাচন কমিশন হাতে নিয়েছে? কমিশনের দেওয়া ভোটার কার্ডের ভিত্তিতে যারা এত দিন ভোেট দিলেন, সেই কার্ড কেন প্রকৃত ভোটারের নথি হিসেবে গ্রাহ্য করা হচ্ছে না?কেনই বা সুপ্রিম কোর্টের সুপারিশ অগ্রাহ্য করা হচ্ছে?
এই দুইটি প্রশ্ন নিয়ে সংসদের অচলাবস্থা অব্যাহত। গোটা সপ্তাহ ধরে লোকসভা ও রাজ্যসভার অধিবেশন হট্টগোলের দরুন মুলতবি হয়ে রইলো। পহেলগাঁও কাণ্ড, অপারেশন সিন্দুর ছাপিয়ে বিহারে ভোটার তালিকা সংশোধন নিয়ে নির্বাচন কমিশনের উদ্যোগের বিরুদ্ধে বিরোধীদের সম্মিলিত প্রতিরোধ কোনো কক্ষে কোনো হতে দেয়নি। বিহার নিয়ে বিরোধীদের কর্মনাশা সিদ্ধান্ত থেকে সংসদকে রেহাই দিতে শেষ পর্যন্ত লোকসভার অধ্যক্ষ বিএসি বৈঠক ডেকে শুক্রবার পাল্টা চাল দিলেন। এতে বিরোধীদের আলোচনায় ফিরতেই হবে। অধ্যক্ষ ওম বিড়লা জানিয়েছেন, সোমবার থেকে সংসদে অপারেশন সিন্দুর এবং পহেলগাঁও হামলা নিয়ে বিরোধীদের যে দাবি ছিল আলোচনার তা শুরু হবে। বিরোধীরা অবশ্য চান, মোদির উপস্থিতিতেই পহেলগাঁও, অপারেশন সিন্দুর ও বিহার নিয়ে আলোচনা করতে, যাতে তাঁকে জবাবদিহিতে বাধ্য করা যায়। প্রধানমন্ত্রী সোমবারে দেশে ফিরে আলোচনায় উপস্থিত থাকবেন- এমনই আভাস মিলছে।
বিরোধীদের বক্তব্য তারা অপারেশন সিন্দুর, পহেলগাঁও নৃশংসতা নিয়ে আলোচনা করতে চান, তবে নির্বাচন কমিশন ভোটার তালিকা সংশোধনের নামে বিহারে নাগরিকত্ব নির্ধারণ প্রক্রিয়া শুরু করেছে তাতে ভুয়া ভোটারের নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার নামে পরিযায়ী শ্রমিক, দরিদ্র মানুষ ও ‘অবাঞ্ছিতদের’ নাম বাদ দেওয়া হচ্ছে। নির্বাচন কমিশনের এই ভূমিকার বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে একাধিক মামলা হয়েছে। লোকসভা ও রাজ্যসভায় বিরোধীরা কমিশনের এই মনোভাবেরই বিরোধিতা করেছেন। বিরোধীদের অভিযোগ, শাসক দল নির্বাচন কমিশনকে এ বিষয়ে উৎসাহিত করছে। সব মিলিয়ে নতুন সপ্তাহ আরও চমকপ্রদ হতে চলেছে সংসদে। বিরোধীরা একদিকে অপারেশন সিন্দুর, পহেলগাঁও নিয়ে তারা যেমন আলোচনার মঞ্চ ছাড়ছেন না তেমনি বিহার নিয়ে তারা তাদের অসহযোগিতার অবস্থান থেকেও নড়বেন না।সেই বিষয়টি দৃশ্যত কেমন হবে?