বিলম্বিত পদক্ষেপ!!

মাত্র কিছুদিন আগেই লালকেল্লায় স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দেওয়ালির উপহারের কথা ঘোষণা করেছিলেন।কিন্তু দীপাবলির আগেই দেবীপক্ষ অর্থাৎ নবরাত্রির প্রথম দিন বাইশ সেপ্টেম্বর থেকে দেশে নতুন হারে পণ্য ও পরিষেবা কর অর্থাৎ জিএসটি পরিবর্তনের ঘোষণা দিলো কেন্দ্র।নিঃসন্দেহে এটা কেন্দ্রীয় সরকারের বড় সিদ্ধান্ত এবং অবশ্যই দেশের কর ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন। বুধবার জিএসটি কাউন্সিলের বৈঠকেই জিএসটির স্ল্যাব চারটি থেকে কমিয়ে দুটি করার সিদ্ধান্ত হয়। অর্থাৎ এখন থেকে জিএসটি হবে দুটি ধাপে। পাঁচ শতাংশ এবং আঠারো শতাংশ। ফলে এখন থেকে আটাশ এবং বারো শতাংশ হারের দুটি ধাপ তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জিএসটি নিয়ে শুরুর সময় থেকেই বিভিন্ন মহলে কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের বাস্তবতা নিয়ে অভিযোগ উঠেছিল। দেখা গেছে জিএসটি চালুর পর অতিরিক্ত করের চাপে বিভিন্ন পণ্য সামগ্রীর চাহিদা দেশে সংকুচিত হয়ে গিয়েছিল। দেশের প্রায় অধিকাংশ বিরোধী দল সহ দেশের শিল্প ও বণিক মহলও এ নিয়ে আপত্তি জানিয়েছেন। কিন্তু সমস্ত আপত্তি উপেক্ষা করেই অনেক ধরনের অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের উপর চড়া হারে – জিএসটি চাপিয়ে মানুষের বোঝা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল কেন্দ্র।এই মাত্রাতিরিক্ত ও অবাস্তবোচিত জিএসটি চাপানোর জেরে দেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিল।একদিকে
কোভিড অতিমারির থাবা এবং এর উপর ক্ষুদ্র, প্রান্তিক ব্যবসায়ী সহ ছোট ছোট দোকানদারেরা ডিজিটাল সিস্টেম এবং অনলাইন ফাইলিং-এর নিয়মের সাথে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে পারেননি।সর্বোপরি ছিল অতিসাধারণ পণ্যে উচ্চহারে পণ্য ও পরিষেবা কর চাপানোর কেন্দ্রীয় সরকারের জেদ।এই সব মিলিয়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ ছোট ফুটপাথ ব্যবসায়ী সহ গ্রামীণ দোকানদারেরা নতুন সিস্টেমের প্রযুক্তিগত সমস্যায় এবং আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়ায় আর্থিক বোঝার কারণে ব্যবসা গুটিয়ে বাড়ি চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন।
যার আঘাত এসে পড়েছিল দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উপর।
তথ্য পরিসংখ্যানে এবং গাণিতিক জটিল সব হিসাবনিকেশ করে সরকারের অর্থনীতির পণ্ডিতরা দেশের জিডিপি বৃদ্ধি এবং আর্থিক দ্রুত অগ্রগতির নমুনা পেশ করলেও দেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে এর ফলে বড় মন্দা এসেছিল সেটা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। ছোট-মাঝারির ক্ষুদ্র অসংখ্য শিল্প ও কারিগরি ইউনিট বন্ধ হয়ে যায়। অগণিত কুটির শিল্পের কারখানায় স্থায়ীভাবে ঝাঁপ পড়তে দেখা যায়। যদিও দেশে জিএসটি তথা পণ্য ও পরিষেবা কর চালুর পেছনে মূল যুক্তি ছিল দেশের কর কাঠামোকে সরলীকৃত করা এবং একাধিক কর ব্যবস্থার পরিবর্তে শুধুমাত্র একটা ব্যবস্থাতেই গ্রাহক ও উদ্যোগপতিদের যুক্ত করা। কেননা জিএসটি চালুর আগে দেশে পরোক্ষ কর বলতে আবগারি শুল্ক, পরিষেবা কর, ভ্যাট, কেন্দ্রীয় বিক্রয় কর এবং অন্যান্য কর ব্যবস্থা কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার দ্বারা পরিচালিত হোক। যার ফলে যথেষ্ট করের বোঝা তৈরি হয়েছিল। মূলত সেগুলি ছিল করের উপর কর। কিন্তু সেগুলিকে স্বচ্ছ ও সরল করার নামে যে নতুন সংকট সরকার ডেকে এনেছিল সেটা ছিল আরও দুর্বিষহ। জিএসটি চাপিয়ে মানুষের করের বোঝা আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে তুলেছিল কেন্দ্র। এই অবস্থায় একদিকে দেশের কর কাঠামোর সংস্কারের মাধ্যমে অর্থনীতিকে উজ্জীবিত করা এবং সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে টানাপোড়েন এবং বিভিন্ন ধরনের অনিশ্চয়তা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন শাসকের সামনে জিএসটির বড় ধরনের সংস্কার করা আবশ্যক হয়ে উঠেছিল। রাজনৈতিকভাবেও এর প্রয়োজনীয়তা বেশ ভালো করেই উপলব্ধি করেছিল কেন্দ্রীয় – সরকার। যে কারণে চলতি বাজেট অধিবেশনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর ছাড়ের পথে এগিয়ে নিম্ন আয়ী এবং সমাজের মধ্যবিত্ত অংশের জন্য আশার আলোও দেখাতে চেয়েছেন কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদি সরকার। আসলে একদিকে দেশে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সম্প্রসারিত না হওয়া, ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, দ্রব্যমূল্যের উচ্চ লম্ফন, বিশেষ করে ওষুধ সহ অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের মূল্যের উপর সরকারের লাগামহীনতা খুব দ্রুতই সরকারকে জনমনে অস্বস্তির দিকে নিয়ে চলেছিল। তা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য এবং এর থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে নিজেদের পায়ের তলার জমি শক্ত করার জন্য বিকল্প পথ ছিল জনগণকে সামান্য হলেও সুরাহা দেওয়া। কার্যত জিএসটি সংশোধনের মাধ্যমে সেই কাজটাই করতে চাইলো সরকার। যার প্রথম ধাপ ছিল কেন্দ্রীয় বাজেটে সাধারণ মানুষকে তৃপ্ত করার প্রয়াস। সেদিক থেকে জিএসটির দ্বিতীয় যাত্রা বলা যেতে পারে দেশের অর্থনীতিকে এবার বাস্তব অর্থেই এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ইতিবাচক বার্তা, কারণ এতে ক্রেতাদের কেনাকাটায় ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। জিএসটির হারে পরিবর্তন এবং স্ল্যাব কমানোয় সাধারণ মানুষের হাতে টাকা আসবে। এতে তাদের খরচের ক্ষমতা বাড়বে,যা প্রকারান্তরে দেশের অর্থনীতিতেই অবদান রাখবে।ইতিবাচক বার্তা দেবে জিডিপিতেও।