বিপন্ন শৈশব

অনেক কাল আগে রূপসী বাংলার কবি সখেদে লিখেছিলেন,অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ!কবি আজ জীবিত থাকলে দেখতেন, শুধু তার মানসলোকে নয়, আক্ষরিক অর্থেই এক অদ্ভুত আঁধার আজ সমগ্র বিশ্বের শৈশবকে এক আজব বিপন্নতায় গ্রাস করেছে। এই বিপন্নতার নাম ডিজিটাল অ্যালগরিদম। এ এক আজব প্রকোষ্ঠ, যার পোশাকি নাম ইন্টারনেট, সেখানে আজকের শৈশব অজান্তেই বন্দি হয়ে পড়ছে। ডিজিটাল পর্দার বিচিত্র দৃশ্যপট শিশুমনকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে এক অলীক স্বপ্নের জগতে, বাস্তবের সঙ্গে যার মিল নেই। ঘন্টার পর ঘন্টা তারা সেখানে বুঁদ হয়ে আছে। পড়াশোনায় আগ্রহ কমে আসছে। হ্রাস পাচ্ছে কল্পনাশক্তি, সৃষ্টিশীলতা।
আজকের দিনে আট থেকে আশি, সকলের মনজুড়ে রয়েছে ডিজিটাল পর্দা। সম্প্রতি রায়পুরস্থিত অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সেসের (এইমস) দুই গবেষক একটি সমীক্ষা চালিয়ে ‘কিউরিয়াস’ নামে এক জার্নালে প্রকাশিত নিবন্ধে জানিয়েছেন, ভারতের গড়ে প্রতি পাঁচ বছরের কমবয়সি শিশু দিনে প্রায় ২ ঘন্টা ২০ মিনিট সময় ডিজিটাল পর্দার সামনে অতিবাহিত করে। দুই বছরের নিচের শিশুদের গড় স্ক্রিন-টাইম ১ ঘন্টা ২০ মিনিট। যে শিশু এখনও জগৎ চেনেনি, মা-বাবার বাইরে পৃথিবী চেনেনি, সেই শিশু এক ঘন্টার বেশি সময় ডিজিটাল দুনিয়ায় আবর্তিত হচ্ছে। বিষয়টি সত্যিই উদ্বেগজনক, কারণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) এই বয়সের শিশুদের জন্য যা সুপারিশ করেছে, তার নির্যাস, পাঁচ বছরের নিচের শিশুদের স্ক্রিন টাইম দিনে এক ঘন্টা এবং তাও অভিভাবকের তত্ত্বাবধানে চলতে পারে। দুই বছরের নিচের শিশুদের ক্ষেত্রে ‘স্ক্রিন এক্সপোজার’ যেন প্রায় শূন্যের কাছাকাছি থাকে।
২,৮৫৭ জন শিশুর উপর করা এই সমীক্ষায় এইমস-এর দুই গবেষক দেখেছেন, পর্দার সামনে অতিরিক্ত সময় কাটানোর ফলে শিশুদের মানসিক বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে এবং শারীরিক স্বাস্থ্যের উপরেও খারাপ প্রভাব পড়ছে। ভাষা ও সামাজিক দক্ষতার বিকাশে দেরি হচ্ছে, ঘুমের স্বাভাবিক ছন্দ বিঘ্নিত হচ্ছে এবং সর্বোপরি মনঃসংযোগের ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। এ সবই ডিজিটাল পর্দার বিরূপ প্রভাব। এই ফলাফল কেবল ভারত নয়, আন্তর্জাতিক স্তরে চালানো গবেষণার সঙ্গেও সঙ্গতিপূর্ণ।
আরও একটি সাম্প্রতিক গবেষণা, যা ‘বিএমজে পেডিয়াট্রিকস ওপেন’ সাময়িকপত্রে সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে তাতে দেখা গেছে উত্তর ভারতের পাঁচটি রাজ্যের ষাট শতাংশ হাঁটতে শেখা শিশু প্রতিদিন দুই থেকে চার ঘন্টা পর্দার দিকে তাকিয়ে থাকে। অন্যদিকে, গত বছর ‘জামা পেডিয়াট্রিকস’ জার্নালে প্রকাশিত একটি বৈশ্বিক গবেষণায় উঠে এসেছে, দুই বছরের কম বয়সি শিশুরা যখন টিভি কিংবা ভিডিও দেখে, তখন সেটি তাদের পরবর্তী জীবনে ইন্দ্রিয়-সংক্রান্ত বিকাশে তফাৎ তৈরি করে দেয়।
টেলিভিশন এখন শিশুদের কাছে পুরনো বিনোদন, আজকের শৈশব, তা শহর হোক বা গ্রামগঞ্জ, দৈনন্দিনতার অঙ্গ স্মার্টফোন। এই গঠনাত্মক বয়সে শিশুদের বিকাশ নির্ভর করে মুখোমুখি মিথস্ক্রিয়ার উপর। স্পর্শ, শব্দ, চোখের ভাষা, এসব সংবেদনশীল অভিজ্ঞতা ও মানুষের সান্নিধ্যই স্বাভাবিক মানসিক বিকাশ, আবেগীয় বোধশক্তি, সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা এবং ভাষা শেখার প্রক্রিয়ার জন্য অপরিহার্য। মোবাইল ফোন বা ল্যাপটপ এই প্রাকৃতিক উদ্দীপনার বিকল্প হতে পারে না। শিক্ষক, মনস্তত্ত্ববিদ ও মন-চিকিৎসকরা বারংবার সতর্ক করছেন, গৃহকোণে ফোন-কম্পিউটারে মগ্ন শিশুরা আন্তর্জালে এমন সব জিনিস দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে, যা মোটেই বয়সোচিত নয়। এমন উৎকট পরিবেশের জন্য সম্ভবত অনেকাংশে দায়ী বর্তমান সমাজব্যবস্থা এবং পরিস্থিতি। বাবা-মায়ের ব্যস্ত জীবনে সময় নেই ছেলেমেয়েদের দিকে তাকানোর কিংবা নজরদারি করার। কাজের চাপে ক্লান্ত অভিভাবকরা যখন শিশুদের শান্ত রাখার জন্য বা নিজেদের একটু সময় পাওয়ার জন্য ফোন বা ল্যাপটপ তাদের হাতে তুলে দেন, তখন তারা যেন মাথায় রাখেন যে, তারা অজান্তেই শিশুদের ডিজিটাল আসক্তির দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। ডিজিটাল পর্দার সামনে অনেকখানি সময় কাটানো কেবল আমাদের ত্রিপুরা, এমনকী দেশেরও নয়, বরং বিশ্বের শিশুদেরও অভ্যাস, সুতরাং উদ্ভুত বিপদটিও স্থানিক নয়, বৈশ্বিক।
এই অর্থে শিশুদের ডিজিটাল আসক্তি সামাজিক পরিবর্তন এবং কাঠামোগত প্রতিবন্ধকতারই পরিণতি। আধুনিক অভিভাবকদের উচিত শিশুদের জন্য আরও কড়াভাবে ডিজিটাল নিয়ন্ত্রণ প্রয়োগ করা। নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ফোন বা ট্যাব থেকে তাদের দূরে রাখা, বা সপ্তাহে একটি নির্দিষ্ট দিন ‘নো-ডিভাইস ডে’ হিসাবে পালন করা, এই ধরনের সচেতন প্রয়াস এখন সময়ের দাবি, শুধু ভারতের নয়, গোটা বিশ্বের ক্ষেত্রেই।