বিপদ সংকেত!!
গত মাসে ব্রাজিলের বেলেমে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপুঞ্জের সর্বশেষ জলবায়ু সম্মেলন আবারও প্রমাণ করলে, উদ্বেগ প্রকাশের জায়গায় দুনিয়া দক্ষ হলেও সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রশ্নে আশ্চর্যরকম উদাসীন। বিশ্ব উষ্ণায়নের বিস্ফোরণসদৃশ ঝুঁকি নিয়ে কথার ফুলঝুরি চলল ঠিকই, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে কোনও কার্যকর রূপরেখা সামনে এলো না। পৃথিবীর স্থলভাগের এগারো শতাংশ জুড়ে থাকা এবং এই সবুজ গ্রহের জলবায়ু নিয়ন্ত্রণে মূল চাবিকাঠি যে হিমবাহ নিয়ে আলোচনা প্রায় অনুপস্থিতিতই রইল।
দুনিয়ার রাষ্ট্রনায়কদের এহেন উদাসীনতাকে মানব সভ্যতার ‘অগ্রগতির’ দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কী আখ্যা দেওয়া যায়! অ্যান্টার্কটিকা ও গ্রিনল্যান্ডের বিশাল মহাদেশীয় হিমবাহ, যা পৃথিবীর বরফভাণ্ডারের ৯৯ শতাংশ, আজ দ্রুত ভাঙছে। এক কোটি ত্রিশ লক্ষ বর্গকিলোমিটারের এই বরফাকীর্ণ বিস্তৃতি গলে গলে মানবসভ্যতার ভবিষ্যৎ কি অবস্থায় দাঁড়াবে, তা সম্মেলনের আলোচনায় বিশেষ গুরুত্বই পেলো না। পৃথিবীর চার মহাশৈত্যে যুগ ও তার অন্তর্বর্তী উষ্ণ প্রবাহচক্রের ইতিহাস সাক্ষী, স্বাভাবিক সময়েও পৃথিবীর তাপমাত্রায় ওঠানামা হতো প্রায় পাঁচ ডিগ্রি। শেষ শীতল প্রবাহের পর গত পনেরো হাজার বছরে পৃথিবী প্রাকৃতিকভাবেই উষ্ণ হচ্ছে, কিন্তু তার সঙ্গে যোগ হয়েছে মানবসৃষ্ট বিপর্যয়। ফলে হিমবাহের পশ্চাদপসরণ আজ ভয়াবহ গতিতে চলছে। বিশ্বের প্রায় সব উচ্চ পর্বতেই গলন বাড়ছে, হিমবাহ উৎপন্ন নদীতে পাথর-বালির বিস্ফোরণসদৃশ বৃদ্ধি তার প্রমাণ। হিমালয়ে চিত্রটি সবিশেষ উদ্বেগের। হিন্দুকুশে প্রতি বছর পনেরো মিটার পিছিয়ে যাচ্ছে বরফ। উত্তরাখণ্ডের ডোকরিয়ানি বছরে পনেরো- কুড়ি মিটার গলছে। ১৯৯৫ থেকে চোরাবাড়ি হিমবাহের পিছু হটার হার ৯-১১ মিটার। এই বিপদের প্রতিধ্বনি আন্তর্জাতিক আলোচনায় যতটা জোরে শোনা উচিত ছিল, ততটাই অনুপস্থিত থাকল। দুনিয়ার সামনে যে নাটকীয় জলবায়ু-অস্থিরতা আসছে, তার ছায়াও যেন সম্মেলনের আলোচনায় পড়ল না। এটাই সবচেয়ে উদ্বেগজনক।

হিমালয় থেকে আল্পস, গ্রিনল্যান্ড থেকে অ্যান্টার্কটিকায় তাপের চাপে হিমবাহ গলে পড়লেও মধ এশিয়ার স্রোতবিহীন, নির্লিপ্ত পর্বতশ্রেণী যেন কোনও অদ্ভুত কারণে বিশ্ব উষ্ণায়নের অভিঘাত অস্বীকার করেছে। কারাকোরাম, তিয়ান শান, কুনলুন আর পামির-হাজার হাজার কিলোমিটার জুড়ে ছড়িয়ে থাকা হিমবাহগুলি গত পঁচিশ বছরে গলেইনি, উল্টো নতুন বরফ জামিয়েছে।বিজ্ঞানীদের কাছে এ এক অস্বাভাবিক রহস্য, যা বৈশ্বিক জলবায়ু- বুকের ভিতর লুকনো বড় প্রশ্নের দরজা খুলে দিচ্ছে। তাজিকিস্তানের বরফে ১০৫ মিটার গভীর গর্ব কার পরেয়করা সংগ্রহ করেছেন বরফের স্তর ইতিহাস।
বরফের জীবনচক্র কিন্তু বড়ই সংবেদী। একই হিমবাহের দু’টি ভিন্ন স্থানে নমুনার বয়স বিশ্লেষণ করলেই তার চলনগতির সুনির্দিষ্ট হিসেব বেরিয়ে আসে, আর সেই তথ্য ভবিষ্যতের জলবায়ু বিপর্যয় ঠেকাতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অথচ হিমবাহের ভবিষ্যৎ এমন অস্থির প্রাকৃতিক সময়ে গবেষণার টেবিলেই নির্ভর করছে। পৃথিবীর জলবায়ু কখনই স্থির ছিল না। উত্তপ্ত পর্বের পর এসেছে বরফে ঢেকে যাওয়া যুগ, আবার তার বিপরীতও ঘটেছে। ইতিহাস বলছে, আন্তঃহিমবাহকালে তাপমাত্রা পাঁচ ডিগ্রি পর্যন্ত লাফ দিয়েছে। এই উষ্ণতা স্বভাবতই বরফগলনকে ত্বরান্বিত করেছে। সব হিমবাহ হয়তো মুছে যাবে না, কিন্তু যেটুকু গলবে, তা যথেষ্ট সমুদ্রস্তর বাড়িয়ে উপকূলকে আরও ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিতে পারে। এই সূত্রে বাড়বে ঝঞ্ঝা, ক্ষয় হবে ভূভাগ।
তাপমাত্রা ও বর্ষার আচমকা বদলে কৃষিতেও ধাক্কা লাগবে। কোথায় কোন্ ফসল ফলবে, কোন্ মরশুমে জমি উপযোগী হবে, তা নতুন করে হিসেব কষতে হবে। মানুষের বাসস্থানও পাল্টে যাবে, ‘অপেক্ষাকৃত শীতল, উঁচু ভূমির দিকে সরে যেতে হতে পারে আমাদের বহু পুরোনো বসতি। এই পরিবর্তন শুধু মাটিতে নয়, সমুদ্রেও। জল গরম হলে বহু সামুদ্রিক প্রাণ টিকতে পারবে না, হারিয়ে যাবে প্রজাতি। আবার উত্তর মেরুর জমাট পৃথিবী উন্মুক্ত হলে বরফে হাজার বছর ধরে নিদ্রামগ্ন অণুজীবের জেগে ওঠার সম্ভবনাও বাড়ছে, যে নমুনা ইতিমধ্যে হাতে এসেছে। পাশাপাশি আবিষ্কৃত হচ্ছে নতুন খনিজ, খনিজ তেল, এমনকী কৃষির জন্য সম্ভাবনাময় নতুন ভূমি। নতুন শহর গড়ে উঠতে পারে।
অর্থাৎ প্রকৃতি পাল্টাচ্ছে। তার বিরুদ্ধে লড়াই করে নয়, বরং সেই পরিবর্তনকে বুঝে, মানিয়ে নেওয়ার মধ্যেই আছে মানবসভ্যতার পরবর্তী পথ। প্রকৃতি যখন নিজের নতুন ছক এঁকে দেয়, তখন লড়াই নয়, বুঝে নেওয়া, মানিয়ে নেওয়া, আর বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে এগিয়ে যাওয়াই মানবসভ্যতার করণযোগ্য পথ। চ্যালেঞ্জ বড়, কিন্তু বিপদ সংকেত টের পেয়েও চোখ বুজে থাকা আরও বিপজ্জনক।