December 13, 2025

বিপদের ঘন্টা!!

 বিপদের ঘন্টা!!

একুশ শতকের প্রথম দশকে ইন্টারনেট যুগের উল্লাসের পর মানব সভ্যতা ভেবেছিল প্রযুক্তি মানেই মুক্তি, উন্নতি। কিন্তু আজ তৃতীয় দশকে দাঁড়িয়ে কঠিন সত্যিটা ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে- আমরা এমন এক প্রযুক্তির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি, যার ভুল ব্যবহারে মানবসভ্যতার মূল কাঠামোই কেঁপে উঠতে পারে। রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার দপ্তরের প্রধান ভলকার টুক সম্প্রতি রিপোর্ট প্রকাশ করে যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তা সাধারণ সতর্কবার্তা নয়, সরাসরি বিপদের ঘন্টা। এ আই-কে নিয়ে দুনিয়া যতটা উচ্ছ্বসিত, বাস্তবে এর অন্ধকার দিক আরও ভয়াবহ। টুর্ক স্পষ্ট বলেছেন, বড় বড় প্রযুক্তি সংস্থাগুলির প্রথম কাজই হল মানুষের ব্যক্তিগত অধিকারে আক্রমণ করা। ডেটা সংগ্রহ, আচরণ বিশ্লেষণ, ব্যক্তিগত তথ্য বিক্রি-সবটাই নীরবে, অনুমতি ছাড়া, দায়বদ্ধতা ছাড়াই। মানুষকে পণ্য বানানো হয়েছে, তার মন-মানসিকতা, রাজনৈতিক পছন্দ-অপছন্দ, নিত্যদিনের অভ্যাস, সবই কারও না কারও ‘ডেটাবেসে’ সম্পদ হিসেবে জমা পড়ে এবং এখানেই এআই সত্যিকার বিপজ্জনক। কারণ এআই শুধু তথ্য নেয়, না, তথ্য বদলায়ও। তথ্য বিকৃত করে, ভুয়ো তথ্য তৈরি করে, মানুষে সিদ্ধান্ত ক্ষমতাকে নষ্ট করে দেয়। সেই শক্তি যদি রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার হয়, তাহলে গণতন্ত্রের মৃত্যু নিশ্চিত। ভোটারকে দিকভ্রষ্ট করা, জনগণকে বিভ্রান্ত করা, বৈরী মতামতকে চিহ্নিত করা, আন্দোলন নিয়ন্ত্রণ, সবই এআই-চালিত নজরদারি ব্যবস্থার মাধ্যমে সম্ভব। আরও ভয়ঙ্কর হলো প্রযুক্তি সংস্থাগুলি নিজেদের উপর কোনোও নিয়ন্ত্রণই চায় না। তাদের ব্যবসা দাঁড়িয়ে আছে ডেটা-লোভের উপর। সহজ কথায় মানুষ কত জানবে, তারা তত বেশি মুনাফা করবে। ফলে, এআই-এর নৈতিকতা, নিরাপত্তা, স্বচ্ছতা এগুলি তাদেদর কাছে নিছক দেখনদারি শব্দ। রাষ্ট্রপুঞ্জের বক্তব্য তাই এতটা ধারালো- এআইকে নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় ছাড়লে এটি ‘ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের দৈত্য’ হয়ে উঠবে। একদম যথার্থ উপমা। কারণ মানুষই এখন এমন এক যন্ত্র বানিয়েছে, যা ভবিষ্যতে মানুষকেই নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখে। এই প্রযুক্তি ভুল হাতে গেলে রাষ্ট্রের দমন-পীড়ন বাড়বে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত হবে, সমাজে অব্যক্ত নজরদারি জারি থাকবে। ইতিহাস সাক্ষী, ক্ষমতা যাদের হাতে থাকে, তারা সেই অস্ত্রের অপব্যবহার করবেই। সমস্যা হলো, সরকারগুলিকেও পুরোপুরি বিশ্বাস করা যায় না। অনেক রাষ্ট্র ইতিমধ্যেই নজরদারিকে ‘নিরাপত্তা’ নামে বৈধতা দিয়েছে। এবার এআই পেলে তারা আরও শক্তিশালী হবে। তাই রাষ্ট্রসংঘ বললেও প্রশ্ন থেকেই যায়-সরকারগুলি কি সত্যিই এআই-নিয়ন্ত্রণে আগ্রহী, নাকি তারা চুপিসারে এই প্রযুক্তিকে নিজেদের স্বার্থেই কাজে লাগাবে? এখন সময় শেষ হওয়ার আগেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার। এআইকে সোনার খনি ভাবা যতটা বোকামি, তাকে দানব হওয়ার সুযোগ দেওয়া তার থেকেও বড় বিপদ। মানবসভ্যতার এই মোড়ে দাঁড়িয়ে আমাদের স্পষ্ট সিদ্ধান্ত নিতে হবে-প্রযুক্তি মানুষের হাতিয়ার হবে, নাকি মানুষই প্রযুক্তির দাস হয়ে যাবে। মূল কথা, সৃষ্টি স্রষ্টার চেয়েও শক্তিশালী হয়ে উঠলে সমূহ বিপদ। এই প্রযুক্তি ক্ষমতা ও সম্পদ মুষ্টিমেয় গোষ্ঠী বা একনায়কদের হাতে কেন্দ্রীভূত করে আর্থসামাজিক অসাম্য বাড়িয়ে বিপুল কর্মহানি ঘটাতে পারে।মানবসভ্যতার অগ্রগতির ইতিহাস আসলে এক দীর্ঘ দ্বন্দ্ব-আবিষ্কার আর আতঙ্কের সহাবস্থান। বিদ্যুৎ আমাদের রাত জয়ের ক্ষমতা দিয়েছে, আবার বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে অসংখ্য।টেলিফোন পৃথিবীকে কাছে এনেছে আবার গোপনীয়তার পর্দা ছিঁড়ে দিয়েছে।অ্যান্টিবায়োটিক মানষকে মৃত্যর দোরগোড়া থেকে ফিরিয়েছে, আবার জন্ম দিয়েছে অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী ‘সুপারবাগ’। সবুজ বিপ্লব খাদ্যের সংকট মেটালেও শুরু হয়েছে মাটির মৃত্যু। কম্পিউটার
ও ইন্টারনেট মানুষকে তথ্য দিয়েছে, একই সঙ্গে নজরদারির এক ভয়ংকর যুগও ডেকে এনেছে। এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে কোনো নির্বাচনের ফল প্রভাবিত করা এখন আর কল্পবিজ্ঞান নয়, ঘোরতর বাস্তব। একই প্রযুক্তি দিয়ে সংঘর্ষ বাধানো, দাঙ্গা উসকে দেওয়া বা আন্তর্জাতিক সংকট তৈরি করাও মোটেই কঠিন নয়। এআই যত মানবসদৃশ হচ্ছে, ততই বাড়ছে এর প্রভাব ও বিপদ। বিশেষত ভারতের মতো এক বিপুল ও বিভাজ্য সমাজে,যেখানে রাজনৈতিক মেরুকরণ চরমে, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান প্রশ্নের মুখে, মিডিয়ার বড় অংশ চাপের নিচে- সেখানে এআই-চালিত বিভ্রান্তি এক ভয়াবহ বিস্ফোরণ ডেকে আনতে পারে।অতএব আজ প্রশ্নটা শুধু প্রযুক্তির নয়,প্রশ্নটা গণতন্ত্রের নিরাপত্তার। এআই যে পথ ধরে ছুটছে, তাতে আগামী বিপর্যয়ের আভাস স্পষ্ট। এখনই সতর্ক না হলে, ‘ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন’-এর গল্পটা আর গল্প থাকবে না, হয়ে উঠবে আমাদের ভবিষ্যতের বাস্তব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *