November 18, 2025

বিপজ্জনক মোড়ে বাংলাদেশ!!

 বিপজ্জনক মোড়ে বাংলাদেশ!!

বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সোমবার দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ডের সাজা ঘোষণা করল সেদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। জুলাই অভ্যুত্থানের পর থেকে ইউনুসের বাংলাদেশে অসংখ্য মামলা হয়েছে হাসিনার বিরুদ্ধে। গুরুতর মামলা গুলোর মধ্যে রয়েছে জুলাই অভ্যুত্থানের ছাত্রদের উপর গুলি চালানো, মানবতাবিরোধী একাধিক অপরাধ এবং আয়নাঘর এর মতো ঘটনা। রায়ে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী সহ প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মৃত্যুদণ্ডের ঘোষণা করা হয়েছে। যদিও এরা দুজনেই বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্য যে রায় ঘোষণার ঘটনা সামনে এসেছে- প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের মাধ্যমে মৃত্যুদন্ড-তা শুধু দুশ্চিন্তার নয়, বিচারব্যবস্থা উপর এক গভীর প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দিয়েছে। আদালতে বাইরে রাজনৈতিক সংঘর্ষ, প্রশাসনিক পক্ষপাতের অভিযোগ ও প্রতিহিংসার আবহে দাঁড়িয়ে এই রায়কে ‘ন্যাচবিচার’ বলা কতটা সম্ভব-তা নিয়েই এখন জনমনে বিতর্ক তুঙ্গে। একটি বিচারের মৌলিক শর্ত হলো স্বচ্ছতা, সময়, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ, নিরপেক্ষ বিচারক এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত পরিবেশ। কিন্তু যা সামনে এসেছে, তা এই পাঁচটির কোনোটির সঙ্গেই খাপ খায় বলে মনে হয় না। বরং অভিযোগ, মামলার নোটিশ ঠিকমতো পৌঁছায়নি, আইনজীবী পছন্দের সুযোগ পাননি অভিযুক্ত, ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের আগাম অবস্থান রাজনৈতিক প্রশাসনের সঙ্গে অস্বাভাবিক সাযুজ্যপূর্ণ-এমন সব প্রশ্ন এই রায়কে আরও বিতর্কিত করে তুলেছে।
বিচারকক্ষের ভেতরে রায় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই হাততালি পড়ে যাওয়া কোনও গণতান্ত্রিক দেশের আদালতে স্বাভাবিক দৃশ্য নয়। বিচার নিজেই যখন উপস্থিতদের শান্ত থাকতে অনুরোধ করতে বাধ্য হন, তখন বোঝাই যায় বিচার আর জনতার রাজনৈতিক আবেগের মধ্যে সীমানাটি কতটা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে গেছে। আদালত যদি উৎসবমুখর স্থানে পরিণত হয়, তবে সেখানে ন্যায়বিচারের গাম্ভীর্য আর বাকি থাকে কোথায়!
প্রসঙ্গ আরও গুরুতর হয় যখন মনে রাখা যায়-এই ট্রাইব্যুনাল মূলত মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত। আজ এই ট্রাইবুন্যালকে ব্যবহার করা হচ্ছে সম্পূর্ণ সমসমায়িক রাজনৈতিক সংঘর্ষ, ছাত্র আন্দোলনের দমন বা প্রশাসনিক ব্যর্থতার অভিযোগ বিচার করতে। এটাই কি ট্রাইবুন্যালের উদ্দেশ্যে ছিল? যদি না হয়, তবে এই ব্যবহারের উদ্দেশ্যে কী? সত্যিই কি বিচার, নাকি রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে চিরতরে সরিয়ে দেওয়ার কৌশল?
অভিযোগ আছে-পুলিশ, সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে যেসব মামলা চলছে, সেখানে অভিযুক্তদের আত্মপক্ষসমর্থনের সুযোগ ছিল সীমিতি। একাধিক সূত্রে বলা হয়েছে, সরকার-নিযুক্ত আইনজীবীর কথোপকথন বিচারকের সঙ্গে মিলে এমন ইঙ্গিত দেয় যে মামলাটি গুরুত্ব সহকারে লড়ার কোন চেষ্টা ছিল না। যদি এসব সত্য হয়, তবে তা বিচারব্যবস্থার প্রতি নাগরিক আস্থার সরাসরি অবমাননা।একই সঙ্গে সরকারের আপ্রান চেষ্টা- সর্বোচ্চ সাজা আদায় করা, এমনকি রায় ঘোষণার পরপরই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করানোর জন্য আবেদন- জনমনে প্রশ্ন তোলে এই বিচার কি আদালতের? নাকি ক্ষমতার রাজনৈতিক প্রয়োগ? এমন রায়ের সময় দেশের অভ্যন্তরে ‘লকডাউন’-এর ডাক, রাজনৈতিক উত্তেজনা, প্রতিবাদ- এসব দিয়ে স্পষ্ট যে সমাজ দুই ভাগে ভেঙেছে। বিচার যদি হয়, তা সমাজকে আরও বিভক্ত করার জন্য নয়, বরং ন্যায্যতার অনুভূতি ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু এই রায়ে তার কোনও বহিঃপ্রকাশ নেই। বিচার কেবল রায় নয়, বিচার হল প্রক্রিয়া। আর সেই প্রক্রিয়া যদি ভয়, পক্ষপাত, প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ, প্রতিহিংসা ও অস্বচ্ছতায় ভরে থাকে- তবে বিচার নয়, সেটাই প্রহসন। যে দেশে ন্যায়বিচার রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত হয়, সেখানে কেউই নিরাপদে থাকে না-না আজকের ক্ষমতাবান, না কালকে বিরোধী।

আজ যাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে- তার বিরুদ্ধে অভিযোগ সত্য কি মিথ্যা, তা আদালত ছাড়া কেউ স্থির করতে পারে না। কিন্তু আদালতই যদি প্রশ্নের মুখে পড়ে, তবে সেই রায় মানুষ কতটা বিশ্বাস করবে। গণতন্ত্রে বিচার‍্যবস্থার প্রতি নাগরিক আস্থা ভেঙে পড়া মানে পুরো রাষ্ট্রের ভিত্তি নড়ে যাওয়া। বাংলাদেশ আজ সেই বিপজ্জনক মোড়ে দাঁড়িয়ে। সত্যিকার বিচার চাইলে-বিচার থাকতে হবে ক্ষমতার উর্ধ্বে। আর সেই দিনই মানুষের আস্থা ফিরবে। আজকের রায়ে সেই আশার আলো দেখা গেল না, বরং আরও গাঢ় হলো প্রহসনের ছায়া।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *