December 13, 2025

বিজেপির বঙ্গবিজয়!!

 বিজেপির বঙ্গবিজয়!!

ভোটার তালিকার নিবিড় সংশোধনের মহাযজ্ঞ,গো-বলয়ের চেনা হিন্দুত্ব বনাম বাঙালিয়ানা, কেন্দ্রের দাপট বনাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংগঠন;কে কাকে টপকাবে তা নিয়েই যত কৌতূহল। গত ৪ নভেম্বর থেকে দেশের আরও এগোরোটি রাজ্যের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে ভোটার তালিকায় যে নিবিড় সংশোধন বা এসআইআরের প্রথম ধাপে গণনাপত্র বিলির কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছিল, বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে তা শেষ হয়েছে। ২০২৫ সালের সর্বশেষ তালিকায় বাংলায় মোট ভোটার ছিলেন প্রায় ৭.৬৬ কোটি। কমিশন সূত্রে খবর, এনুমারেশন পর্ব শেষে ৫৮ লক্ষের কিছু বেশি নাম বাংলার ভোটার তালিকা থেকে বাদ যেতে চলেছে। ১৬ ডিসেম্বর খসড়া তালিকা প্রকাশ হলে এই সংখ্যাটা কিছুটা বাড়তে পারে বটে তবে খুব বেশি নয়। পক্ষান্তরে এই পর্বান্তরে তৃণমূলের ঠিক কতটা ক্ষতি হল এবং তাদের ক্ষতি কতটা, সেই স্পষ্ট হিসাবটা বিজেপি নেতাদের কাছেও নেই। যদিও বাদ পড়া ভোটারের সংখ্যায় ইতিমধ্যে উজ্জীবিত গেরুয়া শিবির। তারা মনে করছে, ভুয়ো ভোটারের কল্যাণেই তৃণমূল এতদিন টেক্কা দিয়েছে। কিন্তু এবার তাদের সেই খেলা সাঙ্গ হবে।
এক্ষণে তাই অমোঘ প্রশ্নঃ বিজেপির বঙ্গবিজয়ের সম্ভাবনা কতদূর? চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল পেয়েছিল ৪৬ শতাংশের বেশি ভোট, বিজেপি প্রায় ৩৯ শতাংশের কিঞ্চিৎ বেশি। ব্যবধান ছিল ৪২.১৮ লক্ষ ভোট। পশ্চিমবঙ্গের মতো বৃহৎ রাজ্যে সরল পাটিগণিতের নিয়মে নির্বাচনের জয়-পরাজয় সূচিত হয় না। তবে বিজেপির হিসাবটি সহজ; সেটি হল, চব্বিশের লোকসভায় হিন্দুদের মোট ৭০ শতাংশের মধ্যে তৃণমূলের হাতে আছে মাত্র ১৫ শতাংশ। বাকিটাই তাদের নিশানায়। অতিরিক্ত চার-পাঁচ শতাংশ হিন্দু ভোট পালে আনতে পারলেই বঙ্গবিজয় হাতের মুঠোয়।
তৃণমূলের জমানায়! সংখ্যালঘু মুসলিমদের তোষণ ও বিক্ষিপ্ত ভাবে একাধিক এলাকায় সাম্প্রদায়িক হিংসার উদাহরণ সামনে রেখে হিন্দুদের উপর আক্রমণের অভিযোগ বিজেপির প্রধান হাতিয়ার। তবে কেন্দ্রের শাসকদল নিছক তৃণমূলকে সরিয়ে বঙ্গ দখলের লড়াইয়ে সীমাবদ্ধ থাকতে চাইছে না। একে হিন্দুদের জীবন, জীবিকা ও সম্মান রক্ষার লড়াই হিসেবেও তুলে ধরতে চাইছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু তোষণ ও হিন্দুদের উপর আক্রমণই যে বিজেপির মূল ইস্যু, সাম্প্রতিক বঙ্গ সফরে গিয়ে তা ঠারেঠারে স্পষ্ট করে দিয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এবং তদপরবর্তী পর্যায়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র, দিল্লী ও সর্বশেষ বিহারে ভোটপর্ব যদিও আবার প্রমাণ করেছে যে হারানো জমি ফিরে পেতে হিন্দুত্বের জুড়ি নেই, কিন্তু শুধুমাত্র চরম মুসলমান-বিদ্বেষের রাজনীতির এক ও অদ্বিতীয় বেদীর উপর দাঁড়িয়ে বিজেপি বঙ্গে তাদের বহু-প্রতীক্ষিত ফল পাবে কিনা বলা কঠিন। কারণ বাংলায় খেলা একেবারেই আলাদা। বঙ্গের মতো ত্রিপুরাতেও বামেরা দীর্ঘদিন ধরে শিকড়ের তলদেশ পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছিল, সেখানেও বিজেপি উপর্যুপরি দু’বার সরকার গঠন করেছে। প্রতিবেশী আসামে চল্লিশ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্ক সত্ত্বেও দাপটের সঙ্গে সরকার পরিচালনা করছে বিজেপি। কিন্তু বাংলায় এখনও তাদের দুর্বল সংগঠন, অভ্যন্তরীণ বিভাজন, আর মাঠের লড়াইয়ে নেতৃত্ব প্রায় অনুপস্থিত। ঘটনা ঘটলেই নেতারা রাস্তায় নেমে লড়াই না করে ছুটে যান আদালতে বা যে যার লেটারহেড ব্যবহার করে নালিশ জানান দিল্লীতে। এই মানসিকতার বদল না ঘটলে বিজেপির বঙ্গবিজয় সুদূরপরাহতই থাকবে।
বাংলার রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক কাঠামো ঐতিহাসিক তাৎপর্যের সূত্রেই আলাগা। গো-বলয়ের চেনা হিন্দুত্বের একরৈখিক প্রচার বঙ্গের উদারবাদী বাঙালিয়ানার দেওয়ালে ধাক্কা খায়। তাই হিন্দুত্বের বটিকা একই ভাবে বঙ্গেও কার্যকরী হবে, এমন ভাবনা সরলিকীকরণ। তবু বিজেপির উৎসাহে ঘাটতি নেই, কারণ তাদের দৃঢ় বিশ্বাস- এতদিন ভুয়ো ভোটেই চলেছে তৃণমূলের রাজত্ব, যা এবার এসআইআরের ছাঁকনিতে বাতিল হবে।
অথচ এ-ও সত্যি যে, বাদ যাওয়া নামের মতো নতুন করে যুক্ত ভোটারের সংখ্যাটি বাংলায় নেহাত কম হবে না। বিয়োগের পাশাপাশি যোগের খেলাও কম তাৎপর্যের নয়। মহারাষ্ট্র, বিহার, সব জায়গায় ভোটারের আকস্মিক সংখ্যাবৃদ্ধি নিয়েই বিস্তর প্রশ্ন আছে বিরোধীদের। বঙ্গে ভোটার যোগ-বিয়োগের খেলায় কারা শেষমেশ লাভবান হবে তা-ও গোপন নয়। আর যদি একফোঁটা নতুন ভুয়ো ভোটারও যোগ হয় তা তৃণমূলের দিকেই যাবে, কারণ একটাই; তাদের সংগঠন।
এখানেই নীরব দুশ্চিন্তা বিজেপির। বঙ্গ বিজেপি যদি এখনও সেই অপেক্ষায় থাকে যে দিল্লী কালীঘাটের নির্দিষ্ট একটি পরিবারে আঘাত করবে, আর সেই সুযোগে তারা ফাঁকা মাঠে যদৃচ্ছ গোল দিয়ে যাবে, সেটিও তাদের দিবাস্বপ্ন বই অন্য কিছু নয়।লড়াই ভরা মাঠেই লড়তে হয়, দক্ষ খোলোয়াড় ফাঁকা মাঠের জন্য অপেক্ষা করে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *