নেপাল হয়ে বিহারে ঢুকেছে জইশ জঙ্গি, রাজ্য জুড়ে চূড়ান্ত সতর্কতা!!
বাঙলায় গান গাই!!

সাম্প্রতিক কালের এক ঘটনায় ভারতে বাঙালিদের মধ্যে অন্য সারতির ধরনের ভাবনাচিন্তার প্রকাশ ঘটতে শুরু করেছে। এমনিতে ভারতে বাঙালিদের জাতীয়তাবাদ কোথাও দানা বাঁধে না। দেশ ভাগের পর এই দেশে বাঙালিরা কোথাও অসমিয়া বাঙালি, কোথাও ত্রিপুরি বাঙালি। বাঙালি বাঙালিরা শুধু পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা। তবে পশ্চিমবঙ্গে একটা আঞ্চলিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান হচ্ছিল খুব ধীরলয়ে। হঠাৎই সেটা সুনামিতে পরিবর্তিত হতে শুরু করেছে গত কয়েক মাসে। এই সময়ে পশ্চিম বাঙলা এবং ত্রিপুরার বাইরে বাঙলাভাষিদের বাংলাদেশি বলে চিহ্নিত করা শুরু হয়েছে। বিশেষ করে শ্রমিক অংশের মানুষদের ক্ষেত্রে যারা হিন্দি এলাকায় কাজ করতে যাচ্ছেন তাদের বাংলাদেশি বলা শুরু হয়েছে, গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কোথাও কোথাও ভারতীয় কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে পুশ ব্যাক করার ঘটনা ঘটেছে।
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক অপেক্ষাকৃতভাবে খারাপ হওয়ার পর, ভারতে প্রচার শুরু হলো, বাংলাভাষী মানুষের অনেকেই আসলে বাংলাদেশ থেকে এসেছেন। এই প্রচারে ভর করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বাঙালিদের গ্রেপ্তার বা হেনস্তা করা হচ্ছে। যাঁরা হেনস্তার শিকার হলেন, তাঁদের বড় অংশ বাঙালি মুসলমান। একটা অংশ হিন্দুও রয়েছে। প্রধানত যাঁরা খেটে খান, মূলত পরিযায়ী শ্রমিক। দু-একজন মধ্যবিত্তও বিপদে পড়লেন। বাঙালির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে-এই রকম একটা ভয় ও আবেগ ছড়িয়ে পড়ল। পশ্চিম বাঙলায় মিটিং, মিছিল, গান-কবিতা, সভা-সমিতি, যা এখনো বাঙালির প্রধান অস্ত্র-সেসব শুরু হলো। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কিংবা কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গের যে কোনও জেলা সদরে বিকাল বা সন্ধ্যা হলেই শোনা যাচ্ছে মাইকে গান বাজছে ‘মুক্তির মন্দির সোপানতলে’ কিংবা ‘আমি ত বাংলায় গান গাই’।আবেগ গণআন্দোলনে পরিণত হচ্ছে।
এ নিয়ে কোনো সন্দে নেই যে বাঙালি বা আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদ রাজনৈতিকভাবে ২০২৬ সালের পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচনে সাহায্য করবে তৃণমূল কংগ্রেসকে। গত ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার ফলে তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে যে অ্যান্টি ইনকামবেন্সি স্বাভাবিকভাবেই এক বিরোধিতার হাওয়া তৈরি হয়েছে, তা অনেকটাই থিতিয়ে যাচ্ছে নব্য বাঙালি জাতীয়তাবাদের দাপটে।এর সঙ্গে কাজ করছে বিহারে নিবিড় খসড়া ভোটার তালিকার সমীক্ষা।এই নিয়েও চলছে তুমুল। বাংলায় ভোট আসবে বিহারের পরে। বিহারে এখন ‘ভোট চোর গদ্দি ছোড়’ যাত্রা করছেন রাহুল গান্ধী। বাঙলায় সেই রকম কোনও যাত্রা না থাকলেও নির্বাচনি নাটকের মঞ্চ রয়েছে সর্বত্র। বিজেপি যখন পশ্চিমবঙ্গে তাদের উত্তর ভারতের ফর্মুলা ধরে হিন্দু বনাম মুসলমানের দ্বন্দ্ব তৈরি করে ভোট টানতে চাইছে, তখন তৃণমূল চাইছে বাঙালি বনাম অবাঙালি-বহিরাগত’র বাইনারি তৈরি করতে। এই অবস্থান এর আগে দুটি নির্বাচনে, ২০২১-এর বিধানসভা এবং ২০২৪-এর লোকসভায় তৃণমূলকে সাহায্য করেছে। কিন্তু তখন ভারতের অন্য প্রান্তে বাঙালিদের বাংলাদেশি হিসাবে চিহ্নিত করার পরিস্থিতি ছিল না।
পশ্চিম বাঙলায় যে আঞ্চলিকতা তা যে পুরোপুরি হিন্দি এবং কেন্দ্রীয় সরকারের বিরোধিতা তা কিন্তু আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ট্র্যাডিশন ধরে মাইকে ‘আমি বাংলায় গান গাই’-এর তীব্রতা থেকে স্পষ্ট। অতীতেও সেই ঐতিহ্যের হাত ধরে জনপ্রিয় হয়েছেন মমতা। নানান কারণে এই জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়লেও বাঙালিকে বাংলাদেশি বলে হেনস্তার মধ্য দিয়ে জাতীয়তাবাদের যে হাওয়া, তাতে পরের নির্বাচনেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিশেষ অসুবিধা হবার নয়। অন্যদিকে বিজেপির নেতারা যতই বলুন না-বেআইনি অনুপ্রবেশকারী চিহ্নিত করার প্রয়োজন আছে, তাদেরও ভাবা দরকার যে প্রায় ১০ বছর ধরে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে গড়ে ৩৫-৪০ শতাংশ হারে ভোট পায়, গত বিধানসভা নির্বাচনে পেয়েছে ৭৭টি আসন। বাঙালি আইডেন্টিটি কেন্দ্রিক যে আবেগ তৈরি হয়েছে, তাতে বিজেপি এই আসনগুলি ধরে রাখতে পারলে অবাক হতে হবে পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে।
কিন্তু বিজেপি বাঙালি বিরোধিতায় অনড়।তাঁরা মনে করছে এটাই সঠিক পথ। তাই পশ্চিমবাংলার বিজেপি নেতারা অন্য রাজ্যে বাঙালি হেনস্তার প্রতিবাদ করছেন না। হয়তো এর কারণ হল, যে সব রাজ্যে ঘটনাগুলি ঘটছে সেসব রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় রয়েছে। কিংবা বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বুঝে গেছেন আগামী বছর জেতার আসা নেই; কারণ পশ্চিমবঙ্গে দলীয় নেতৃত্বের নড়বড়ে অবস্থা। বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে যে অবস্থায় আছে, তাতে তাদের পক্ষে রাজ্যের আনুমানিক ৮০ হাজার বুথে পোলিং এজেন্ট দেওয়া মুশকিল-এমন রাজনৈতিক সমীক্ষা বাজারে রয়েছে। আবার বাঙালিবিদ্বেষ কাজে লাগিয়ে আসাম ও বিহারে তারা ভালো ফল করতে পারে। আগামী ছয় মাসের মধ্যে বিহার ও আসামে বিধানসভা নির্বাচন রয়েছে। ওই দুই রাজ্যে বিরোধিতার হাওয়া বইছে বিজেপির বিরুদ্ধে। কারণ, সেই সব রাজ্যে এককভাবে বা অন্যদের সঙ্গে বিজেপি দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় রয়েছে। এই দুই রাজ্যে অনুপ্রবেশের বিষয়টিকে অন্যতম প্রধান ইস্যু হিসেবে সামনে আনা হচ্ছে মূলত পশ্চিমবঙ্গ ছাড়তে হবে, এই হিসাব জেনেশুনেই।পশ্চাতে কারণ যাই হোক, আপাত দৃষ্টিতে দেখা যাচ্ছে বাঙালিবিরোধী রাজনীতির জেরে সমাজের সব স্তরের মানুষ, এমনকী যারা ঘোর তৃণমূল কংগ্রেস বিরোধী, তারাও বাঙালি জাতীয়তাবাদের মঞ্চে আসতে বাধ্য হচ্ছে। ইতিহাস স্বাক্ষী, আধুনিক ভারতে গত ১০০ বছরের বেশি সময় পশ্চিমবঙ্গের যেসব নেতা-নেত্রীকে মানুষ মনে রেখেছে, তাঁরা প্রায় প্রত্যেকেই কেন্দ্র অর্থাৎ দিল্লীর বিরোধীতা করেছেন। সুভাষচন্দ্র বসু চিত্তরঞ্জন দাস, শরৎচন্দ্র বসু-তাঁরা সবাই নেহরু-গান্ধী নেতৃত্বাধীন কংগ্রেসের বিরোধিতা করেছিলেন। শরৎচন্দ্র বসু তো হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে মিলে অবিভক্ত বাংলা গঠনের দিকে অনেকটা এগিয়েও গিয়েছিলেন। রাসবিহারী বসু সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে স্বাধীনতা আনতে চেয়েছিলেন, নেহরু গান্ধীর অহিংসার রাস্তা থেকে সরে। পশ্চিমবঙ্গ তাদের মনে রেখেছে। বর্তমানের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের আবার ফিরিয়েও আনা হচ্ছে। অন্যদিকে দিল্লীর সঙ্গে মিশে রাজনীতি করার ফলে অনেক বড় নেতা প্রায় হারিয়ে গেছেন। যেমন অতুল্য ঘোষ, প্রণব মুখোপাধ্যায়। কিন্তু সুভাষ বসু বা বিধান রায় হারাননি।