বরাক, উত্তর-পূর্ব ও ত্রিপুরাকে নিয়ে,জলপথে নয়া অধ্যায় সূচনার সম্ভাবনা!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-উত্তর-পূর্বের প্রতিটি এলাকা সহ বরাক উপত্যকার এবং ত্রিপুরাকে কেন্দ্র করে ভারতের জলপথ পরিবহণে এক নতুন অধ্যায় শুরু হতে চলেছে।বহু দশকের অবহেলার পর আবারও নদীমুখী অর্থনীতি ও পরিবহণ ব্যবস্থার পুনর্জাগরণ ঘটাতে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। আজ গুয়াহাটিতে আয়োজিত এক বিশেষ রোডশোতে কেন্দ্রীয় বন্দর, জাহাজ পরিবহণ ও জলপথ মন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়াল ঘোষণা করেন, ব্রহ্মপুত্র ও বরাক নদীকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক মানের জলপথ ও পর্যটন অবকাঠামো তৈরি হবে। এই উদ্যোগ শুধু উত্তর-
পূর্বের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করবে না, বরং গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্ককেও নতুন দিশা দেখাবে।
গুয়াহাটিতে আয়োজিত অনুষ্ঠানটির নাম দেওয়া হয়েছিল ‘জল পরিবহণে উত্তর-পূর্ব জলপথে পর্যটন ও ফেরি পরিষেবার গতিবৃদ্ধি’। ভারতীয় অন্তর্দেশীয় জলপথ কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে এই রোডশো আয়োজন করা হয় আসন্ন ভারত সামুদ্রিক সপ্তাহ ২০২৫কে সামনে রেখে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন আসামের পরিবহণ মন্ত্রী যোগেন মোহনসহ রাজ্যের একাধিক বিশিষ্ট আমলা, শিল্পপতি ও নীতি নির্ধারকরা। মন্ত্রী সোনোয়াল তার বক্তব্যে বলেন,
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দূরদর্শী নেতৃত্বে ভারত আজ সামুদ্রিক শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করছে। সাগরমালা প্রকল্প থেকে সবুজ নৌচালনা, গঙ্গা থেকে ব্রহ্মপুত্র ও বরাক, সকল ক্ষেত্রেই সরকার জলপথ পরিবহণকে এগিয়ে নিতে ব্যাপক বিনিয়োগ করছে। সবচেয়ে বড় ঘোষণা ছিল ব্রহ্মপুত্র নৌপথে বিলাসবহুল ক্রুজ পরিষেবা চালুর। সোনোয়াল জানান, ২০২৭সালের মধ্যে ব্রহ্মপুত্রে দুটি আন্তর্জাতিক মানের ক্রুজ জাহাজ নামানো হবে, যার জন্য প্রাথমিকভাবে ২৫০ কোটির বিনিয়োগের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এর ফলে উত্তর-পূর্বে নদীভিত্তিক পর্যটন এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছবে। ব্রহ্মহ্মপুত্রের অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে ঘিরে বিশ্বমানের পর্যটন চাহিদা তৈরি করা সম্ভব হবে বলে আশাবাদী মন্ত্রী।বরাক উপত্যকার উন্নয়ন নিয়েও আজকের রোডশোতে বিস্তারিত আলোচনা হয়। বরাক নদীকে ইতিমধ্যেই জাতীয় জলপথ-১৬ ঘোষণা করা হয়েছে। শিলচর, করিমগঞ্জ, বদরপুর অঞ্চলে আধুনিক কার্গো টার্মিনাল তৈরির কাজ দ্রুত এগোচ্ছে। ইতিমধ্যেই শিলচর ঘাট থেকে পণ্য পরিবহণ শুরু হয়েছে। এর ফলে বরাক উপত্যকা শুধু আসামের অভ্যন্তরীণ বাজারের সঙ্গেই নয়, বরং বাংলাদেশের সিলেট হয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গেও সরাসরি সংযুক্ত হবে। এতে শিলচর, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি সহ বরাকের তিন জেলার ব্যবসা-বাণিজ্যে বিপুল সম্ভাবনা তৈরি হবে। ত্রিপুরার ক্ষেত্রেও জলপথ পরিবহণের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হচ্ছে। আগরতলা হয়ে গোমতী নদীর পুনর্জাগরণকে কেন্দ্র করে ৮. নৌচলাচল চালু করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ভারত-বাংলাদেশ এর প্রটোকল রুট ব্যবহার করে ত্রিপুরাকে বাংলাদেশের আখাউড়া-আশুগঞ্জ নদীপথের সঙ্গে সংযুক্ত করার কাজ শুরু হয়েছে। এর ফলে ত্রিপুরার ব্যবসায়ী মহল সরাসরি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সুযোগ পাবে। সোনোয়াল স্পষ্ট ভাষায় জানান, এই উদ্যোগ কার্যকর হলে ত্রিপুরা শুধুমাত্র উত্তর-পূর্বেই নয়, সমগ্র ভারতের বাণিজ্য মানচিত্রে একটি কৌশলগত কেন্দ্র হয়ে উঠবে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আরও ঘোষণা করেন যে ডিব্রুগড়ে একটি আধুনিক আঞ্চলিক উৎকর্ষতা কেন্দ্র স্থাপন করা হবে, যেখানে সামুদ্রিক প্রযুক্তি, স্মার্ট নেভিগেশন, লজিস্টিকস, আতিথ্য ও পর্যটন সংক্রান্ত বিষয়ে উচ্চমানের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। ১৮৮ কোটির ব্যয়ে গড়ে উঠা এই কেন্দ্র আগামী ১৯ মাসের মধ্যে চালু হবে। সরকারের লক্ষ্য, আগামী কয়েক বছরে অন্তত ৫০,০০০ > তরুণ-তরুণীকে এই খাতে প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেওয়া। এর ফলে উত্তর-পূর্বের শিক্ষিত যুবসমাজের সামনে এক নতুন দিগন্ত খুলে যাবে। গত দু’বছরে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ইতিমধ্যেই এক হাজার কোটির বেশি বিনিয়োগ হয়েছে জলপথ অবকাঠামোয়। করিমগঞ্জ, ধুবড়ি, বগীবিল, শিলচর ও আগরতলার মতো জায়গায় আধুনিক টার্মিনাল তৈরি হচ্ছে। পাশাপাশি গ্রামীণ সংযোগ উন্নত করার জন্য ৮৫টি কমিউনিটি জেটি নির্মাণ করা হচ্ছে। এর ফলে প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষকরা সহজে বাজারে তাদের পণ্য পৌঁছে দিতে পারবেন। পরিবহণ খরচ কমবে এবং – লাভজনক কৃষি বাণিজ্যের রাস্তা খুলবে। সোনোয়াল বলেন, স্বাধীনতার পর বহু দশক ধরে নদীভিত্তিক পরিবহণ অবহেলিত হয়েছিল। অথচ পরিবেশবান্ধব, ব্যয়সাশ্রয়ী এবং দীর্ঘমেয়াদে পরিবহণ ব্যবস্থা হিসাবে নদী পথের বিকল্প নেই।
তিনি জানান, বর্তমানে আসাম ও উত্তর-পূর্বে প্রায় ১১৬৮ কিলোমিটার নৌপথ কার্যকর হয়েছে, যেখানে নিয়মিত কার্গো ও যাত্রীবাহী ফেরি চলছে। ব্রহ্মপুত্র, বরাক, ধনশিরি ও কপিলী নদীতে যেভাবে নতুন করে জীবন ফিরছে, তা এক ঐতিহাসিক অধ্যায়ের সূচনা। আগামী ২৭ থেকে ৩১ অক্টোবর মুম্বাইয়ে ভারত সামুদ্রিক সপ্তাহ ২০২৫ অনুষ্ঠিত হতে চলেছে, যেখানে শতাধিক দেশের প্রতিনিধি অংশ নেবেন। উত্তর-পূর্ব ভারতের জলপথ এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এর গুরুত্ব নিয়ে আলাদা অধিবেশন থাকছে।সোনোয়াল মনে করেন, এই সম্মেলনের মাধ্যমে উত্তর-পূর্ব ও বরাক উপত্যকার জলপথকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে তুলে ধরা সম্ভব হবে। সোনোয়াল তার বক্তব্যে আরও বলেন, ‘বরাক ও ত্রিপুরার মতো অঞ্চলে জলপথের উন্নয়ন মানে শুধু অর্থনৈতিক দিক নয়, সাংস্কৃতিক বিনিময় এবং পর্যটনের ক্ষেত্রেও নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেওয়া।ভারত-বাংলাদেশ প্রটোকল রুট সক্রিয় হওয়ার পর এই অঞ্চল আন্তর্জাতিক বাজারের নতুন প্রবেশদ্বার হয়ে উঠবে।এটি হবে আত্মনির্ভর ভারতের উত্তর-পূর্বের সবচেয়ে বড় অবদান।’আজকের রোডশোতে উপস্থিত
শিল্পপতিরাও কেন্দ্রীয় সরকারের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানান।