December 10, 2025

বন্দেমাতরম ও রাজনীতি!!

 বন্দেমাতরম ও রাজনীতি!!

‘বন্দেমাতরম’ গানটি সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অমর সৃষ্টি। গোড়া থেকেই বঙ্কিমের ঐতিহাসিক ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের এই গানটি নিয়ে বিতর্ক ছিল। দেড়শো বছর ছুঁয়েও সেই বিতর্ক ফের একবার প্রকট হয়ে উঠেছে। আর এই বিতর্কের পিছনে যে ‘রাজনীতি’ রয়েছে, তা বুঝতে কারও বাকী নেই। গোড়াতেও বিতর্কের পিছনে যে রাজনীতি ছিল, সেটাও অস্বীকার করার উপায় নেই। ফারাক শুধু সময় ও রাজনৈতিক ক্ষমতার পট পরির্তনে। যে কারণে দেড়শো বছর পরেও ফের একবার ‘বন্দেমাতরম’-কে নিয়ে বিতর্ক দানা বেঁধেছে।
বন্দেমাতরম গানটি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক শক্তিশালী প্রতীক। যা সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাস থেকে এসেছে। এই গান দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের মন্ত্র হিসাবে কাজ করেছে।
কিন্তু এই গানের চরিত্র নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক রয়েছে। যা ভারতের রাজনৈতিক ও সামাজিক আলোচনায় বারবার উঠে এসেছে। ‘বন্দে মাতার’ কথাটি’র সহজ অর্থ হলো ‘মা তোমাকে প্রনাম করি”। এখানে ‘মা’ বলতে ‘মাতৃভূমি’- কে বোঝানো হয়েছে। এই ‘বন্দেমাতরম’ গানটি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের একটি শক্তিশালী ধ্বনি এবং চেতনার প্রতীক হয়ে ওঠে। এটি শুধুমাত্র একটি গান ছিল না, এটি গোটা ভারতবাসীকে একত্রিত করার, স্বাধীনতা সংগ্রামে উজ্জীবিত করার এবং মাতৃভূমিকে দেবীরূপে কল্পনা করার একটি মাধ্যম ছিল।
‘বন্দেমাতরম’ ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সঞ্জীবনী মন্ত্র। লড়াইয়ের শক্তি। হাসিমুখে জীবন বলিদানের প্রেরণা। হিন্দু জাতীয়তাবাদের উদ্ধত পতাকা। ঐতিহাসিক তথ্য বলছে, ১৮৭৫ সালে ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এই গানটি রচনা করেছিলেন। ১৮৮২ সালে প্রকাশিত হয়েছিল তার ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাস। আর সেখানেই ছিল বন্দেমাতরম গানটি। সেই নিরিখে এই গানটির বয়স এখন দেড়শো বছর। আনন্দমঠ উপন্যাসে যাদের কেন্দ্র করে লেখা, সেই সন্তান দলের কন্ঠে গানটি উপন্যাসে ব্যবহৃত হয়েছিল। উপন্যাস প্রকাশের পরেই গানটি এবং বন্দে মাতরম ধ্বনিটি প্রবল জনপ্রিয় হয়ে উঠে। ১৮৯৩ সালে বঙ্কিমচন্দ্রের মৃত্যুর তিন বছরের মধ্যেই এই গান ওঠে আসে রাজনৈতিক দলের সম্মেলনের মঞ্চে। ১৮৯৬ সালে জাতীয় কংগ্রেসের এক সম্মেলনে এই গানটি প্রথম পরিবেশন করেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এরপর অনেক জল গড়িয়েছে।বন্দে মাতরম গানটিকেই জাতীয় সঙ্গীত হিমারে অবহিত করা হয়। কিন্ত স্বাধীনতার পর এই গানটির বদলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘জনগনমনকে’ জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা দেওয়া হয়। আর বন্দে মাতরমকে বলা হয় জাতীয় স্তোত্র। তবে আনন্দমঠ উপন্যাসে থাকা গানের মূল পাঠটিকে জাতীয় স্রোত্র না করে, তার প্রথম অংশটিকে কেবল জাতীয় স্তোত্র হিসেবে বেছে নেওয়া হয়। আর এখানেই বিতর্ক দানা বাঁধে। সেই বিতর্ক এখন আবার মাথাচড়া দিয়ে উঠেছে। বলা ভালো নতুন করে বিতর্ক উসকে দেওয়া হয়েছে।
কালজয়ী এই গানের ‘মা’- কে ভারতমাতা হিসেবে কল্পনা করা নিয়ে হিন্দু এবং অ-হিন্দুদের মধ্যে কিছু বিতর্ক ছিল। যে কারণে অ-হিন্দুদের খুশী করতে তৎকালীন সময়ে গানটির বড় অংশ বর্জন করা হয়েছিল। সময়ের পট পরিবর্তনে গানটির দেড়শো বছর পরেও সেই বিতর্ক আবার উসকে দিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এই গানটির বড় অংশ বর্জনের জন্য তৎকালীন কংগ্রেস নেতৃত্বকে সরাসরি দায়ী করেন প্রধানমন্ত্রী মোদি। তার বক্তব্য, এই বর্জনের সূত্র ধরেই দেশে বিভাজনের বিজ মাথাচাড়া দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিল। আর এই বিভাজনই দেশভাগের দিকে ইতিহাসকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। মোদ্দাকথা কংগ্রেসের তোষণের রাজনীতিই দেশকে বিভাজনের পথে হাঁটতে বাধ্য করেছে। যার ফসল দেশভাগ। তবে একটা কথা বলতে হবে, ‘বন্দেমাতরম’ একটি কালজীয় গান যা ভারতীয় রাজনীতিতে জাতীয়তাবাদ, ঐক্য এবং প্রতিরোধের প্রতীক হিসাবে কাজ করেছে। কিন্তু এর ব্যবহার এবং ব্যাখ্যা সব সময়ই রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্র বিন্দুতে থেকেছে।হয়ত ভবিষ্যতেও থাকবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *