প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তির ঘড়া!!

ব্রাজিলের রাজধানী রিও ডি জেনিরো-তে সদ্য অনুষ্ঠিত ব্রিকস সম্মেলনে ভারতের কটনৈতিক মান কতদূর রক্ষিত হলো,কতটা প্রাপ্তি হলো এবং কতটা অপ্রাপ্তির সুর অনুরণিত হলো-স্বল্প কথায় তার বিচার করতে বসা মুর্খামি।একদল দাবি করতে পারেন, পহেলগাঁও কাণ্ডের দেড় মাস পরে ব্রিকস-এ নয়াদিল্লীর কূটনৈতিক মান রক্ষিত হলো না। যুক্তি হিসাবে তারা বলতে পারেন, রিও-র যৌথ বিবৃতিতে পহেলগাঁও কাণ্ডের নাম করে, শুধু সন্ত্রাসবাদের কড়া নিন্দা করা ছাড়া বাকিটা জি-৭ কিংবা চিনের এসসি-ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকের মতোই অন্তঃসারশূন্য। তেমনটা যদিও হয়নি, বরং যৌথ বিবৃতিতে পহেলগাঁও হত্যাকাণ্ডে নিন্দা প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। এর ফলে আসন্ন সেপ্টেম্বরে রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ অধিবেশনের আগে হাত কিছুটা শক্ত হয়েছে মোদির। তা হলে অপ্রাপ্তির ছায়া কোথায়? যৌথ বিবৃতিতে পহেলগাঁও কাণ্ডের নিন্দা করা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু কোথাও পাকিস্তানের নাম উল্লেখ করে আমাদের যুযুঋন রাষ্ট্রকে কাঠগড়ায় তোলা সম্ভব হয়নি। ইসলামাবাদের সর্ব আবহাওয়ার মিত্র বেজিং, ব্রিকসের অন্যতম প্রভাবশালী দেশ, সম্ভবত তাদের আপত্তিতেই পাকিস্তান বিরোধীতাকে সরাসরি সামনে আনা যায়নি। এই সূত্রে বিরোধীদের হাতে নয়া হাতিয়ারও এসেছে। আগামীতে তারা অভিযোগ তুলতে পারেন, ভারতের গরিব জনতার সামনে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানের উদ্দেশে চোখা চোখা বাক্যবাণ প্রয়োগে বিলক্ষণ পটু হলেও বিশ্বমঞ্চে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানের ‘পা’ উচ্চারণ করতেও হাঁটু কাঁপে প্রধানমন্ত্রীর। প্রথম প্রতিরক্ষা মন্ত্রী, তারপর বিদেশ মন্ত্রী ও অবশেষে প্রধানমন্ত্রী; পহেলগাঁও কাণ্ডের পরে বিশ্ব সংসারের সামনে কেউই পাকিস্তানের নামোচ্চারণ করতে পারলেন না। ব্রিকসে প্রধানমন্ত্রী মোদি চিনের প্রধানমন্ত্রী লি চিয়াংয়ের মঞ্চ ভাগ করেছে। কোন্ চিন? দিন কতক আগেই ভারতীয় সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ অব আর্মি স্টাফ রাহুল আর সিংয়ের বয়ান ধার করে বললেন, অপারেশন সিঁদুরে পাকিস্তানকে শিখণ্ডি খাড়া করে লড়াই করছিল আসলে চিণা।
এবারে ব্রিকস সম্মেলন এই প্রথম রাশিয়া-চিন-দক্ষিণ আফ্রিকা-নতুন সদস্যসহ নতুন অভিঘাত নিয়ে সংগঠিত, যা ছিল ভারতের জন্য একাধিক গুরুত্ব বহনকারী কূটনৈতিক পরীক্ষণ। ভারত যেমন অর্থনৈতিক ও কৌশলগত কিছু অর্জন করেছে, তেমনই প্রত্যাশার বৃত্তটিও সম্পূর্ণ হয়নি। প্রাপ্তি প্রসঙ্গে বলার প্রথমত, ভারত ‘গ্লোবাল সাউথ’ তথা উন্নয়নশীল বিশ্বের নেতৃত্বে বহুপাক্ষিকতা যে মুখ্য উদ্দেশ্যে, অর্থাৎ উন্নয়নমুখী প্ল্যাটফর্মে কন্ঠের প্রাধান্য, সেটি অর্জিত হয়েছে। সম্মেলনের ঘোষণাপত্রে উন্নয়নশীল দেশের জন্য অর্থায়ন, পরিবেশ সুরক্ষার জন্য গ্রিন ফান্ড এবং প্রযুক্তি উদ্ভাবনে ভারসাম্যপূর্ণ ভূমিকার গুরত্বের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী মোদি তার ইনক্লুসিভমাল্টিল্যাটারালিজম অর্থাৎ সকলের অংশগ্রহণ-নির্ভর বহুপাক্ষিক ব্যবস্থার নীতি সফলভাবে তুলে ধরেছেন। দ্বিতীয়ত, সম্মেলনে স্থানীয় মুদ্রা-বাণিজ্য ও নতুন ব্রিকস পেমেন্ট ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা এগিয়েছে। যৌথ বিবৃতিতে তা স্থানও পেয়েছে। তৃতীয়ত, সম্মেলনের পার্শ্ব বৈঠকে মোদির নেতৃত্বমূলক ভূমিকায় ভারত-ব্রাজিল সহযোগিতা প্রসারিত হয়েছে। চতুর্থত, অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন সম্মেলনে ‘বিশ্বব্যাপী বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান সংস্কারের প্রয়াসে ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়ন-এর প্রয়োজন তুলে ধরেছেন, যা ভারতীয় অর্থনৈতিক মডেল ও কৌশলগত দৃঢ়তার প্রমাণ।
প্রাপ্তি থাকলেই অপ্রাপ্তি থাকে।ভারতের জন্য রিও-র মঞ্চেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। সম্মেলনে রাষ্ট্রসংঘ-আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডার-বিশ্ব ব্যাঙ্ক সংস্কার নিয়ে নয়াদিল্লীর যে প্রত্যাশা ছিল, তা পূর্ণ সামঞ্জস্যে বাস্তবায়িত হয়নি। ভ্লাদিমির পুতিন এবং শি জিনপিং, ব্রিকসের সর্বাপেক্ষা শক্তিধর দুই দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের অনুপস্থিতি ছিল ব্রিকসভুক্ত বাকি রাষ্ট্রের কাছে এক কঠিন রাজনৈতিক সঙ্কেত। একই সঙ্গে এই সম্মেলনে বোঝা গেল না যে, ব্রিকস কখন মূল অর্থনৈতিক মহাসড়ক হিসেবে কার্যকর হবে, বা ভৌগোলিক বৈষম্য দূরীকরণে কতদূর সহায়ক হবে। সব মিলিয়ে রিয়ো ডি জেনিরো-র ঘোষণাপত্রে মোদি সরকারের ঘরোয় রাজনীতিতে স্বস্তি রয়েছে ঠিকই,কিন্তু পাকিস্তান থেকে আস সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তা কতটা কাজে দেবে তা নিয়ে সন্দেহ থেথেই যাচ্ছে।
উপসংহারে বলার, ব্রিকস পশ্চিমি শক্তির জোট ন্যাটোর মতো নয় ব্রিকস গোষ্ঠীবদ্ধভাবে একটি বিবৃতি দিয়ে কাজ সারতে পারে, কিন্তু তার সদস্যভুক্ত রাষ্ট্রের সঙ্কটে পাশে দলবদ্ধভাবে এসে দাঁড়িয়েছে এমন কোনও দৃষ্টান্ত নেই। ফলে মূল প্রশ্ন দুইটি এবং যার উত্তর এখনও কালের গর্ভে। এক) ভবিষ্যতে ব্রিকস সূত্রে বিশ্ব-অর্থনীতির নতুন মডেল সৃষ্টি হবে কি না, দুই) ব্রিকস ভারত- গ্লোবাল সাউথ নেতৃত্বাধীন শক্তি ন্যাটোর প্রতিস্পর্ধী অক্ষ হয়ে উঠতে পারে কি না।