প্রতিবিপ্লব
মানুষ আজ আর চোখে চারপাশে দেখে না,দেখে শুধু মোবাইলের স্ক্রিনে। বাসে, ট্রেনে, দোকানে, কফি শপে যেদিকেই তাকান, সবাই যেন এক অদৃশ্য নেশার জালে আটকে আছে। ইউটিউব যেন জেট-সেট সভ্যতার যুগের নয়া আফিম। ছোট দোকানদার থেকে শুরু করে কলেজপড়ুয়া- গ্রাহক, কাজ, দায়িত্ব, সময়; কিছুই আর গুরুত্বপূর্ণ নয়। ভিডিও শুরু হলেই পৃথিবী অদৃশ্য। এ কি সভ্যতার বিবর্তন-নাকি এক নির্মম অবনতি? মানুষ বই থেকে সরে যাচ্ছে, চিন্তা থেকে পালাচ্ছে। প্রকৃত শিক্ষা, বিশ্লেষণ, যুক্তি, সব হারাচ্ছেন স্ক্রিনে ভেসে ওঠা অর্ধসত্য, মিথ, প্রোপাগান্ডার ঢেউয়ে। আমরা জ্ঞানের বদলে তথ্য-আবর্জনা গিলছি, মনোযোগের বদলে পাচ্ছি বিভ্রান্তি, আর মানুষের স্বাভাবিক বুদ্ধি-কৌতূহল ধুঁকে মরছে ‘ভিডিও’র জোয়ারে। বস্তুত, এ এক প্রকার সামাজিক মহামারি। শুধু সময় নষ্ট হচ্ছে না, মানুষ নিজের বোধশক্তি চেড়ে দিচ্ছে প্রযুক্তির হাতে। স্ক্রিনে যা দেখানো হচ্ছে, তাই সত্যি, তাই বাস্তব- এমন এক বিপজ্জনক অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে সমাজ। সবচেয়ে দুঃখজনক, এই নেশা বয়স মানে না-আট থেকে আশি, সবাই একই দলে।
যা হচ্ছে, তা কোনও ‘ডিজিটাল বিপ্লব’ নয়- এ হলো এক ভয়ানক প্রতিবিপ্লব- যেখানে মানুষ জ্ঞানের জায়গা দিচ্ছে বিভ্রান্তিকে, পাঠের জায়গা দিচ্ছেপ্যাসিভ ভোগান্তিকে আর চিন্তার জায়গা দিচ্ছে তুচ্ছ বিনোদনের দাসত্বকে।
২০০৫ সালে আনকোরা এক ওয়েবসাইটে মাত্র উনিশ সেকেন্ডের একটি ছোট্ট ভিডিয়ো যখখ আপলোড করা হয়েছিল তখন কেউ ভাবতেও পারেননি, তা ছিল আসলে মহাসিন্ধুর প্রথম বিন্দু।চিড়িয়াখানার হাতির এনক্লোজারের বাইরে এক তরুণ কিছু বলছেন। সেদিনের সেই ওয়েবসাইটই কুড়ি বছর পর আজ ‘ইউটিউব’ নামে দুনিয়া কাঁপাচ্ছে, বদলে দিয়েছে মানুষের ‘দেখা’র দর্শন। টিভির চৌকো বাক্স মানুষের চার দেওয়ালের মধ্যে গোটা বিশ্বকে এনে দিয়েছিল, কিন্তু ডিজিটাল প্রযুক্তি ও আন্তর্জালকে সঙ্গী করে, মোবাইল বা স্মার্টফোনের আধারে যে বিপ্লব, মতান্তরে প্রতিবিপ্লব ইউটিউব সম্ভব করেছে তা এক কথায় বেনজির। এই কুড়ি বছরে তার ভাণ্ডারে কুড়ি বিলিয়নেরও বেশি ভিডিয়ো, বিশ্বজুড়ে ইউটিউব ব্যবহার করছেন দু’শো কোটিরও বেশি মানুষ, প্রতি মাসে গড় ‘অ্যাক্টিভ ইউজার’ ছাড়িয়েছে ১০০ কোটি।
কিন্তু যে কথাটি সাধারণ মানুষও বুঝতে পারবেন না তা হল, ইউটিউব আসলে মানুষের অতি মৌলিক একটি প্রবণতাকে দোহন করেছে-তা হল ‘দেখা’ ও ‘দেখানো’। মানুষ সব সময়ই দেখতে চায়, অন্যের জীবনকে তুচ্ছাতিতুচ্ছ ক্ষুদ্র ও যারপরনাই বৃহৎ সমেত দেখার এক প্রবল আগ্রহ তার মধ্যে কাজ করে, এবং দেখতে দেখতেই তার মধ্যে আসে ‘দেখানোর’ প্রণোদনাও। ইউটিউব এই জায়গাটিই ধরতে পেরেছে অত্যন্ত সফল ভাবে, খুলে দিয়েছে অষ্টপ্রহর দেখে চলার এক অপার দুনিয়া। তবে এটাও ঠিক যে, ইউটিউব মানুষের সহজাত ‘দেখার অধিকার’কে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে, মানুষ কী দেখবে তা নিয়ে কোনও বিচারসভা বসায়নি বংর সেই অধিকারকে করে তুলেছে রোজকার সহজ অভিজ্ঞতা, এখানেই তার কৃতিত্ব। খাবার খেতে অনিচ্ছুক শিশুটির সামনে ইউটিউবের বিচিত্র ভিডিয়ো খুলে দিতেই সে বিনা বাক্যব্যয়ে খেয়ে নিচ্ছে- এই উদাহরণগুলি বলেই দেয়, শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলের মনে ও জীবনে আজ এর কী প্রবল প্রভাব। এই প্রতাপ বাড়বে বই কমবে না, একটি ভিডিয়ো দেখতে দেখতে আজ ইউটিউবের অ্যালগরিদম উপভোক্তাকে পরের একটি ভিডিয়ো ‘সাজেস্ট’ করছে, দর্শকের কী পছন্দ মুহূর্তেই বুঝে নিয়ে তাকে প্রভাবিত ও চালিত করছে সমধর্মী ‘কনটেন্ট’-এর দিকে। এই যান্ত্রিক চতুরালি আসলে মানবিক ক্ষমতার উপরেই খোদকারি কি না, তাতে কোনও বিপত্তি লুকিয়ে তা সময়ই বলবে। তবে মানুষের দেখতে চাওয়া আর দেখাতে চাওয়ার অভ্যাসটিও তো থাকবেই- তাই ইউটিউবের জয়যাত্রাও অব্যাহত থাকার কথা।
সভ্যতা সামনে এগোয় বটে, কিন্তু আজ আমরা যে দিকে ছুটছি, তা অগ্রগতি নয়- এ পশ্চাৎপদতার ছদ্মবেশী তাণ্ডব। মানবমস্তিষ্কের স্বাধীনতা, মনন, সৃষ্টিশীলতা, সবই বিপন্ন। এই নেশা শুধু সময় খায় না, মানুষকেও খেয়ে ফেলছে। এখন প্রশ্ন একটাই, আমরা কি ভবিষ্যৎকে ক্রিনের হাতে সমর্পণ করে দিতে চাই, নাকি নিজের মস্তিষ্ককে আবার নিয়ন্ত্রণে আনতে চাই? এ কি সভ্যতার এক পর্বে এসে জন-বিপ্লব, নাকি অজান্তেই সংগঠিত হয়ে চলেছে এক প্রতিবিপ্লব